একদিনে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামাতে পারে চীন?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০৫ পিএম
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন ইউক্রেন একটি নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে, তখন চীনের কাছে দেশটির গুরুত্ব সীমাবদ্ধ ছিল আকরিক লোহা, শস্য ও সূর্যমুখী তেলের মতো কাঁচামালে। কিন্তু তিন দশকের ব্যবধানে সেই সম্পর্ক এক নাটকীয় বাঁক নিয়েছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের ড্রোননির্ভর যুদ্ধক্ষেত্র—ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক ঘুরপাক খাচ্ছে ইতিহাস, প্রযুক্তি ও ভূরাজনীতির এক জটিল আবর্তে।
এই সম্পর্কের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় ১৯৯৮ সাল। সেবার ইউক্রেন মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে সোভিয়েত আমলের আধা-নির্মিত বিমানবাহী রণতরী ‘ভারিয়াগ’ চীনের কাছে বিক্রি করে। মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা বিশাল এই জাহাজটি কেনার সময় বেইজিং দাবি করেছিল, এটি নাকি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর করা হবে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্ব দেখল, সেই পরিত্যক্ত রণতরীই হয়ে উঠেছে চীনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিমানবাহী রণতরী ‘লিয়াওনিং’।
এটি ছিল কেবল শুরু। চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলতে ইউক্রেনের কারিগরি সহায়তা ছিল বিস্তৃত ও গভীর। হেলিকপ্টার ও শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি, নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন, এমনকি বিমান বিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানও কিয়েভ থেকে পৌঁছেছে বেইজিংয়ে।
ইউক্রেন নিজেই পরে স্বীকার করে, এক সময় তারা অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল চীনে পাঠিয়েছিল। এই প্রযুক্তি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই সম্পর্ক যেন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা প্রকাশ্যেই বলছেন, যুদ্ধের গতি অনেকটাই নির্ভর করছে বেইজিংয়ের ওপর। ইউক্রেনের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, চীন চাইলে এক দিনের মধ্যেই এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারে। শুধু ইউক্রেন বা রাশিয়ার কাছে ড্রোনের যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করলেই যথেষ্ট।
বর্তমানে ইউক্রেনের আকাশে উড়তে থাকা লাখ লাখ ড্রোনের প্রায় প্রতিটি উপাদানেই রয়েছে চীনের ছাপ। ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি থেকে শুরু করে নেভিগেশন মডিউল—সবকিছুর উৎস মূলত চীনা কারখানা।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামের একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন কার্যত চীনা আমদানিনির্ভর। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট ও থার্মাল সেন্সরের মতো কৌশলগত কাঁচামালে চীনের একচেটিয়া আধিপত্য কিয়েভকে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অবস্থায় ফেলেছে।
তবু যুদ্ধের পর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ইউক্রেনের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, দেশ পুনর্গঠনে চীন হতে পারে অন্যতম প্রধান কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, তারই একটি আধুনিক ও বাস্তবমুখী সংস্করণ চায় কিয়েভ।
চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পেও ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে ইউক্রেনকে একটি প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচ মনে করেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইউক্রেনকে বড় অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মুখে পড়তে হবে। বিশেষ করে সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে ইউরোপীয় মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাক চালু করা ছাড়া চীনের জন্য ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশ সহজ হবে না।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্য তেল ও সয়াবিনের অন্যতম বড় ক্রেতা। এই বাণিজ্যই যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনীয় অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রাখছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য হতে পারে একটি ঐতিহাসিক ভুল। তাঁর ভাষায়, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলেই চলবে না; চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলাই হবে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
সমরাস্ত্রের গোপন অতীত আর ড্রোনযুদ্ধের অনিশ্চিত বর্তমান পেছনে ফেলে কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত পেরোবে না বিদেশি সেনা, বরং চলাচল করবে পণ্যবাহী ট্রেন ও জাহাজ।



