Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ককপিটের অডিও- এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ০৩:৫৬ পিএম

ককপিটের অডিও- এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে

ছবি - সংগৃহীত

ভারতে গত মাসে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট১৭১ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে ভয়ানক এক তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারাওড়ার মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরই ১২ বছরের পুরনো বোয়িং৭৮৭ ড্রিমলাইনারের দুই জ্বালানি-নিয়ন্ত্রণ সুইচই ‘কাট-অফ’ বা বন্ধ হয়ে যায়। এতে ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সাধারণত উড়োজাহাজ অবতরণ করার পরই জ্বালানি সুইচ ‘কাট-অফ’ অবস্থায় রাখা হয়।

ককপিটের ভয়েস রেকর্ডিংয়ে শোনা যায়, একজন পাইলট অন্য পাইলটকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘তুমি কেন কাট-অফ করেছ?’ আরেকজন জবাব দিয়েছেন, ‘আমি করিনি।’ তবে কে কোন কথাটি বলেছেন, তা রেকর্ডিং থেকে স্পষ্ট নয়। সহ-পাইলট উড়োজাহাজ চালাচ্ছিলেন, আর ক্যাপ্টেন তদারকি করছিলেন।

সুইচগুলোকে পরে আবার স্বাভাবিক ফ্লাইট অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়, এতে ইঞ্জিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবারও সচল হয়। তবে বিধ্বস্ত হওয়া নাগাদ একটি ইঞ্জিন শক্তি ফিরে পেলেও অন্যটি তখনো পুরো শক্তি ফিরে পায়নি। এরপর এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটটি ৪০ সেকেন্ডের কম সময় আকাশে ছিল। এটি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদ শহরের একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিধ্বস্ত হয়।

এটিকে ভারতের অন্যতম রহস্যময় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ঠিক কী কারণে উড়োজাহাজটি ওড়ার পরই বিধ্বস্ত হলো, তা জানতে তদন্ত কর্মকর্তারা এর ধ্বংসাবশেষ এবং ককপিট রেকর্ডারগুলো পরীক্ষা করছেন।

ফ্লাইটরাডার২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটটি পরিষ্কার আবহাওয়ায় ৬২৫ ফুট উচ্চতায় উঠে উড়ছিল, কিন্তু ৫০ সেকেন্ড পরই এটির অবস্থানের তথ্য হারিয়ে যায়। আজ শনিবার প্রকাশিত ১৫ পৃষ্ঠার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে বোয়িং, জিই, এয়ার ইন্ডিয়া, ভারতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড ও যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা এই তদন্তে অংশ নিচ্ছেন। তবে এই তদন্তে যে তথ্যগুলো পাওয়া গেছে, তাতে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

তদন্তকারীরা বলছেন, জ্বালানি সুইচগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেন তা ভুল করে চাপ লেগে চালু না হতে পারে। এই সুইচ চালু করতে হলে আগে এটিকে টেনে তুলে আনলক করতে হয়, তারপর ঘুরিয়ে চালু করা যায়। এই নিরাপত্তাব্যবস্থা ১৯৫০-এর দশক থেকে চালু আছে।

কানাডাভিত্তিক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনাসংক্রান্ত এক তদন্তকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেন, ‘এক হাত নাড়িয়ে দুই সুইচ একসঙ্গে বন্ধ করতে পারাটা প্রায় অসম্ভবআর এ কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।’

আর এ কারণেই এয়ার ইন্ডিয়ার দুর্ঘটনাটি নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে।

ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উড়োজাহাজ নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক বিমান দুর্ঘটনা তদন্তকারী শন প্রুচনিকি বলেন, ‘যদি পাইলটদের একজন ইচ্ছাকৃতভাবে বা ভুল করে সুইচ বন্ধ করে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন উঠবেইকেন তিনি সুইচগুলো বন্ধ করলেন?’

প্রুচনিকি বিবিসিকে আরও বলেন, ‘তা কি ইচ্ছাকৃত ছিল, নাকি কোনো ভুল বোঝাবুঝির ফল? কিন্তু সেটাও মনে হয় না। কারণ, পাইলটরা কোনো অস্বাভাবিক কিছুর কথা জানাননি। অনেক সময় ককপিটে জরুরি পরিস্থিতিতে পাইলটরা ভুল বোতামে চাপ দিয়ে ফেলেন বা ভুল সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এখানে তেমন কোনো পরিস্থিতি হয়েছে বলে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। পাইলটদের কথোপকথনেও জ্বালানি সুইচ ভুল করে চালু হওয়ার ইঙ্গিত ছিল না। বড় ধরনের কোনো গড়বড় হওয়া ছাড়া সাধারণত এমন ধরনের ভুল হয় না।’

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের (এনটিএসবি) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিটার গোয়েলজ বলেন, ‘এ তথ্যটি খুবই চিন্তার বিষয় যে একজন পাইলট ওড়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জ্বালানি সুইচ বন্ধ করেছেন। ককপিটের ভয়েস রেকর্ডারে এর চেয়ে আরও অনেক কিছু থাকার কথা। শুধু একটি বাক্য, “তুমি কেন সুইচ বন্ধ করলে”—এই এতটুকু যথেষ্ট নয়।’

গোয়েলজ বলেন, নতুন পাওয়া তথ্যগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, ককপিটে থাকা কেউ ওই সুইচগুলো বন্ধ করেছিলেন। এখন প্রশ্ন হলোকে করেছিলেন, আর কেন? দুটি সুইচই বন্ধ করা হয়েছিল এবং তারপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার চালু করা হয়েছিল। ভয়েস রেকর্ডার থেকে আরও বেশি তথ্য জানা যাবে। যে পাইলট উড়োজাহাজ চালাচ্ছিলেন, তিনি কি ইঞ্জিন আবার চালু করার চেষ্টা করছিলেন, নাকি যিনি তদারক করছিলেন তিনি?

তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন, ককপিট ভয়েস রেকর্ডার এই রহস্যের মূল চাবিকাঠি। ককপিট ভয়েস রেকর্ডার পাইলটদের মাইকের আওয়াজ, রেডিও কল এবং ককপিটের আশপাশের শব্দ ধারণ করে।

পিটার গোয়েলজ বলেন, ‘তদন্তকারীরা এখনো ভয়েস রেকর্ডারের কণ্ঠস্বর শনাক্ত করতে পারেননি, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ভয়েস রেকর্ডার শোনার সময় পাইলটদের পরিচিত কেউ থাকেন। তাঁরা কণ্ঠস্বর মেলাতে সহযোগিতা করেন। কোন পাইলট সুইচগুলো বন্ধ ও আবার চালু করেছেন তা, এখন পর্যন্ত আমরা জানি না।’

তদন্তকারীরা বলছেন, এখন দরকার হচ্ছে পাইলটদের কণ্ঠস্বর স্পষ্টভাবে চেনা, ককপিটে কারা কী বলেছেন, সেটা লিখে রাখা এবং যাত্রা শুরু হওয়ার পর বিধ্বস্ত হওয়া পর্যন্ত যেসব যোগাযোগ হয়েছে, সেগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করা

তদন্তকারীরা আরও বলছেন, এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় ককপিটে ভিডিও রেকর্ডার থাকা কতটা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড আগেই এটা সুপারিশ করেছিল। পেছন দিক থেকে ধারণ করা ভিডিও থাকলে দেখা যেত, কার হাত কাট-অফ সুইচের ওপর ছিল।

ফ্লাইট১৭১এ ওঠার আগে দুই পাইলট এবং ক্রুদের শ্বাসপ্রশ্বাস পরীক্ষা করা হয়েছিল। তাঁরা সবাই ফ্লাইটের জন্য সুস্থ ও যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। পাইলটরা মুম্বাই থেকে এসেছিলেন। তাঁরা ফ্লাইটের একদিন আগেই আহমেদাবাদে পৌঁছেছিলেন এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তদন্তকারীরা এখন প্রতিবেদনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিকেও বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় উড়োজাহাজ চলাচল প্রশাসন (এফএএ) একটি বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, কিছু বোয়িং৭৩৭ উড়োজাহাজের জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ সুইচে লকিং ফিচার যুক্ত করা নেই।

তথ্যটি জানার পরও সেটাকে এত বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখা হয়নি। একই ধরনের সুইচের নকশা বোয়িং৭৮৭-৮ বিমানেও ব্যবহৃত হয়। এয়ার ইন্ডিয়ার বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজ ভিটি-এএনবিতেও একই ধরনের সুইচ ছিল। এফএএ যে তথ্য দিয়েছিল, তা ছিল পরামর্শমূলক। সে কারণে এটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি এয়ার ইন্ডিয়া। তারা উড়োজাহাজটির নিরাপত্তাব্যবস্থা যাচাইবাছাই করেনি।

শন প্রুচনিকি বলেন, জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ সুইচে কোনো সমস্যা ছিল কি না, তা নিয়ে ভাবছেন তিনি।

প্রুচনিকি বলেন, ‘প্রতিবেদনের এই অংশের মানে আসলে কী? এর মানে কি, একবার সুইচ ঘোরালেই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে? যখন লকিং ব্যবস্থা কাজ করে না, তখন ঠিক কী ঘটে? সুইচ কি নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিতে পারে? যদি তাই হয়, তাহলে এটা খুবই গুরুতর বিষয়। আর যদি না হয়, তাও ব্যাখ্যা করা দরকার।’

তবে অনেকে এটাকে অতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করছেন না।

পিটার গোয়েলজ বলেন, ‘আমি আগে এমন কিছু শুনিনি। এটা সম্ভবত এফএএর কোনো কম গুরুত্বের নোটিশ ছিল। পাইলটরা সাধারণত কোনো সমস্যা হলে খুব দ্রুতই জানান, কিন্তু এই জ্বালানি সুইচ নিয়ে তাঁদের কাছ থেকেও কিছু শোনা যায়নি। প্রতিবেদনে যেহেতু উল্লেখ করা হয়েছে, তাই এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে পারে। তবে আমার মনে হয়, এটা হয়তো শুধু মনোযোগ সরানোর একটা দিক।’

ভারতের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরোর (এএআইবি) সাবেক তদন্তকারী ক্যাপ্টেন কিশোর চিন্তা ভাবছেন, উড়োজাহাজের ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল ইউনিটের সমস্যার কারণে ফুয়েল সুইচ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কি না।

কিশোর বিবিসিকে বলেন, ‘পাইলট কিছু না করেও কি বিমানের ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল ইউনিট থেকে জ্বালানি সুইচ বন্ধ হয়ে যেতে পারে? যদি সত্যিই ইলেকট্রনিকভাবে সুইচ বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সেটা খুবই চিন্তার বিষয়।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উড়োজাহাজে ভরার জন্য নেওয়া জ্বালানির নমুনা পরীক্ষার ফল ‘সন্তোষজনক’। এর আগে কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, দুই ইঞ্জিন একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে জ্বালানির দূষণ একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।

তবে এখন পর্যন্ত বোয়িং৭৮৭ বা এর জিই জিইএনএক্স-১বি ইঞ্জিন নিয়ে কোনো সতর্কতা দেওয়া হয়নি। যন্ত্রাংশের ত্রুটির বিষয়টি নিয়ে আপাতত তদন্ত হচ্ছে না।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উড়োজাহাজের র‍্যাম এয়ার টারবাইন চালু হয়েছিল। এতে স্পষ্ট হয় যে উড়োজাহাজের প্রধান কোনো ব্যবস্থায় বড় ধরনের ত্রুটি হয়েছিল। এ ছাড়া উড়োজাহাজটির ল্যান্ডিং গিয়ার নিচেই ছিল। অর্থাৎ ওড়ার পরও চাকাগুলো ভেতরে ঢোকানো হয়নি।

তদন্তকারীরা আরও বলছেন, ক্রু সদস্যরা পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সবকিছু এত দ্রুত ঘটেছে, যে সময় পাননি।

প্রুচনিকি বলেন, ‘ইঞ্জিন দুটি বন্ধ হয়ে আবার চালু হয়েছিল। পাইলটরা বুঝতে পেরেছিলেন যে ইঞ্জিনগুলোর শক্তি কমে যাচ্ছেতাই সম্ভবত প্রথমে বাঁ দিকের ইঞ্জিনটি চালু করেন, তারপর ডান দিকেরটি। কিন্তু ডানদিকের ইঞ্জিন চালু হলেও ঠিকমতো কাজ করার সময় পায়নি।’


Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন