ফাল্গুন অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের মনে পড়ে যায় ভাষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি, রক্ত ঢেলেছি। ছাত্র যুবারা এ মহৎ কর্মে প্রথম সারির যোদ্ধা। তাদের নিঃস্বার্থ আত্মদানে উদ্বুদ্ধ হয়েছে শিক্ষিত শ্রেণি, পেশাজীবী মানুষ। রক্তের ধারায় প্রবল প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী শ্রেণি- অখ্যাত দুর্গম টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া- অচেনা গ্রাম বাজিতপুর, উপেক্ষিত-অবহেলিত মহকুমা শহর মেহেরপুর আর সাগর সংলগ্ন দুর্গম অঞ্চল কক্সবাজার বা সন্দ্বীপ। গোটা পূর্ববঙ্গ চঞ্চল, বিক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভের মাধ্যমে জেগে উঠেছে মাতৃভাষা বাংলাকেন্দ্রিক ভাষা চেতনা, একুশের চেতনা- সেই ধারায় ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবোধ। এ জাতীয়তাবোধ যতটা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিভিত্তিক তার চেয়ে কম নয় রাজনৈতিক চরিত্রের বিচারে। ভাষা-জমায়েতে ও মিছিলে পুলিশের ও ইপিআর জওয়ানদের গুলিবর্ষণে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে যেসব শহীদ মিনার তৈরি হলো ঢাকা থেকে দেশের বাইরে সর্বত্র- এমনকি পরে রাজধানী ঢাকায় ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার’ সেগুলোও একাধারে সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রতীক। সেই প্রতীক ঘিরে চলছে সংস্কৃতি চর্চা ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের প্রকাশ। এভাবে ভাষা আন্দোলন যা এ দেশে প্রথম গণতান্ত্রিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনরূপে পরিচিত হয়ে উঠেছে জাতীয় চরিত্রের আন্দোলন দলমত আদর্শ নির্বিশেষে। এ আন্দোলনের মর্যাদা গভীর বিচারে শিকড় থেকে জাতিগত চরিত্রের- তাই বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতাদের মুখেও উচ্চারিত হয় এমন বক্তব্য : ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও তার অর্জনের সূতিকাগার- সব প্রতিবাদী আন্দোলনের উৎসমুখ। এই উৎসমুখ থেকে উৎসারিত হয়েছে পরবর্তী সময়ের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন, এমনকি পূর্ব-ঐতিহ্যের মুক্তি সংগ্রাম- একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তো বটেই- ছাত্র-যুবা, রাজনৈতিক কর্মী ও জনগণের আত্মদানে। তুলনাহীন এর তীব্রতা, আন্তরিকতা ও বিস্তার। এ আন্দোলনই প্রথম সারা পূর্ববঙ্গ আলোড়িত করেছে, মানুষকে রাজনৈতিক দিক থেকে সচেতন করতে সাহায্য করেছে। দুই. একুশে তাই আমাদের সংস্কৃতি ও রাজনীতির নিয়ামক উপাদান- সেটা অবশ্য নির্ভর করে একুশে বা তার প্রতীকগুলোকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করি। একুশের আদর্শিক আকাক্সক্ষাগুলোকে কতটা গ্রহণ, বাস্তবায়ন করি, কতটা উপেক্ষা ও অবহেলা করি। হিসাব-নিকাশ নিতে গেলে দেখা যায়Ñ আমরা এর আনুষ্ঠানিকতাটিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় গ্রহণ করেছি। প্রতি বছর তারই প্রকাশ ঘটাই। তাই ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে দৈনিক পত্রিকাগুলো ভরে ওঠে একুশে বন্দনায় এবং তা নানা মাত্রায়, নানা রঙে, নানা আঙ্গিকে।