Logo
Logo
×

বিশেষ সংবাদ

মামলা বাণিজ্য ও হয়রানি প্রসঙ্গ

Icon

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৪ পিএম

মামলা বাণিজ্য ও হয়রানি প্রসঙ্গ

মামলা বাণিজ্য ও হয়রানি প্রসঙ্গ

মামলার কথা আসলে কেমন জানি আদালত ব্যবস্থার কথা মনে পড়ে। কিন্তু মামলা মানে শুধু আদালত নয় মামলার সঙ্গে এদেশের প্রতিহিংসার দলীয় রাজনীতি, কিছু উকিল, মামলাবাজ কিছু  মক্কেল ও কতিপয় অসাধু পুলিশ ও জড়িত। মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নানান ছকে রাজনীতিবিদ নামধারী কিছু কুলাঙ্গার মিথ্যা উক্তিতে মামলা দিয়ে জব্দ করে থাকে। যেটা বর্তমান সময়ে খুবই ঘটছে মানে মিথ্যা হয়রানী মূলক মামলা মোকদ্দমা বেড়েই চলেছে। চলছে রমরমা মামলা বাণিজ্য। এর সঙ্গে কারা জড়িত, কেন জড়িত, মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে বিচার বিভাগের দায় ও ভূমিকা কি তা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। মামলা বাণিজ্য প্রতিরোধ একেবারে শুরু থেকে করতে হবে। যেই একটা মামলা দায়ের বা রুজু হয়ে যায় তখন সেটা নিষ্পত্তি হতে আইনী প্রক্রিয়ায় এগুতে হয়। তাই বিচার ব্যবস্থার উপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। মোটা দাগে মামলা বাণিজ্য রাজনীতিবিদ এবং পেশাজীবি একটা গোষ্ঠী কন্ট্রোল করে থাকে। 

বাড়িতে গেছিলাম শীতকালীন ছুটিতে। এক চাচা বয়স ষাটোর্ধ্ব। তিনি তার দুই পুত্রকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল আইনী পরামর্শ নিতে। কাগজপত্র দেখানোর আগে বললো জুলাই আগস্ট বিপ্লবের সময় সৌদি আরব হজ্জে ছিলাম। আগস্টের ১৪ তারিখ বাড়িতে আসি তার আগে দেশ স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার মুক্ত হয়েছে।  কিন্তু আমরা ফেঁসে গেছি। কিভাবে ফেঁসে গেলেন জিজ্ঞেস করতে জানালো তার ও ছেলেদের নামে আদালতে ও থানায় মিলে মোট চারটি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে দুটটা হত্যা মামলা। আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পরে মামলা করার ধুম পড়ে যায়। স্থানীয় নেতারা পুর্ব শত্রুতার জেরে আরেকজনের মামলায় আসামী বানিয়ে দিয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আপোষের ও প্রস্তাব দিয়েছে।  যাইহোক যেটি বলছিলাম মামলা বাণিজ্য এটা এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে গ্রাম শহর সর্বত্র। আইন সংশ্লিষ্টরা দিশেহারা কোনভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। শুধু এই আমলে না পতিত হাসিনা সরকারের আমলে ও মিথ্যা মামলা করার প্রবণতা ছিল আকাশচুম্বী। বলা যায় হয়রানি মূলক মিথ্যা মামলা বা বিরোধী দল দমনে নাশকতার মামলা দায়েরে এক নম্বরে ছিল বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার। কিন্তু আগস্ট বিপ্লবের স্পিরিট অনুযায়ী জনগণের প্রত্যাশা ছিল সুনির্দিষ্ট অপরাধ ব্যতীত মিথ্যা মামলা বা হয়রানিকর মামলা হবে না। কোন মামলা বাণিজ্য চলবে না বা কেউ মামলা বাণিজ্য করতে চাইলে ছাত্র জনতা তা রুখে দিবে। মোটা দাগে এ যাত্রায় তা হয়নি। বরং মামলা বাণিজ্যের পারদ খানিকটা পূর্বের থেকে উর্ধ্বমুখী। 

চাচাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মিথ্যা মামলা হচ্ছে কেন? চাচার উত্তর ছিল জমিজমা নিয়ে পূর্ব শত্রুতা। কোন এক সময় ঝগড়া হয়েছিল চাচা বলেছিল ঝগড়ার সময় বাদীপক্ষের সেইলোক বলেছিল আগে ক্ষমতায় আসি তারপর মজা দেখাবো। বাদীপক্ষকে কাজে লাগিয়ে নেতা গোছের কিছু লোক প্রতিটি এলাকায় মামলা বাণিজ্য করছে। যাকে তাকে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করছে। টাকা পয়সা নিয়ে আপোষ মীমাংসার জন্য চাপ দিচ্ছে। সত্যিকারের স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অপরাধে মামলা হলে কোন আপত্তি নেই কিন্তু কোনভাবেই সভ্য সমাজে নিরপরাধ কেউ মামলায় জড়িয়ে যাক তা চাই না। মূল কথায় আসি মামলা হওয়ার পিছনে পূর্ব শত্রুতা অনেকাংশেই দায়ী। পূর্বশত্রুতা রাজনৈতিক বা পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ের ও হতে পারে। কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হয়ে ও স্থানীয় ভাবে মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক শত্রুতাবশত মামলা বানিজ্য চলছে হরহামেশাই। এর সাথে জড়িত রয়েছে প্রতিটি পাড়া মহল্লা  গ্রাম ইউনিয়ন বা থানার বর্তমানে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ না থাকায় এলাকায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বা চাঁদাবাজি করছে স্থানীয় বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের লোকজন।

এটা অনেকে বলছেন যে বিএনপি ও তার সমমনা রাজনৈতিক দল ও ওসব দলের নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় এবং নির্যাতিত হওয়ায় সেটার প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে। প্রতিশোধ হিসেবে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা মোকদ্দমা দিয়ে জব্দ করা। জনশ্রুতি রয়েছে এই সুযোগে মামলা বাণিজ্য করছে বিএনপি এবং জাতীয়তাবাদী সমর্থক আইনজীবী ও তার এলায়েন্স। জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা সময় ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করতে কিছু টাউট কিসিমের তথাকথিত শিক্ষিত উকিল নামধারী আইনজীবী গ্রামের পাতি নেতার সহযোগিতায় পিটিশন লিখে মামলা দাঁড় করাচ্ছে যা পরবর্তীতে কিছু অসাধু পুলিশের সহযোগিতায় থানায় ও কোর্টে মামলা বাণিজ্যের মহোৎসব করছে যা সত্যি ছাত্র জনতার বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং করছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা, অন্যায়ভাবে জেলে আটকিয়ে রাখা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এতোদিন অবৈধভাবে যা কামিয়েছে তা টিকিয়ে রাখতে বর্তমান আমলের নেতাকর্মীদের ভাগ দেওয়া, নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, উপরের নেতার মনোযোগ আকর্ষণে মামলা বাণিজ্য হচ্ছে বলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করছে। ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে ও মামলা বাণিজ্য হচ্ছে।  এখন প্রশ্ন উঠতে পারে বিএনপি তো এখনো ক্ষমতায় আসেনি তাহলে তাঁরা কেন ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। এটা কারোরই অজানা নয় যে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক শক্তি। তৃণমূলে এই দুই দলের প্রচুর নেতাকর্মী রয়েছে যা অন্য কোন দলের নেই। জামায়াত ও ছাত্র শিবিরের কিছু নেতাকর্মী থাকলে ও ভোটের রাজনীতিতে এতোটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম নন এখনো।

সম্প্রতি মাননীয় আইন উপদেষ্টা মামলা বাণিজ্য হচ্ছে তা স্বীকার কিভাবে বাণিজ্য ঠেকানো যায় সে বিষয় ও তিনি বক্তব্য তুলে ধরেছেন। কারা মামলা বাণিজ্য করছে এবং কেন করছে মে বিষয় হুশিয়ারী করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের আহবান জানিয়েছেন। আবার অনেকে বলে থাকে দখলদারি, চাঁদাবাজি ও মামলা বাণিজ্যের জন্য  বিএনপি ও আওয়ামী লীগ হচ্ছে রেলস্টেশনে একই প্লাটফর্মে হারিয়ে যাওয়া আপন দুই জমজ ভাই। তবে যে যাই হোক কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া দুনিয়ার আইনে শুধু নয় সৃষ্টিকর্তার আইনেও মারাত্মক পাপ। মিথ্যা ও হয়রানিকর মামলা মোকদ্দমার সাথে জড়িত বাদী ও সাক্ষী পরকালে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবে বলে কোরান হাদিসে উল্লেখ করেছে। মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য দেশীয় আইনে ও শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। জুলাই আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিস্ট সরকার কি বিদায় হয়েছে না হয়নি। একজন ফ্যাসিস্ট গেছে আরেকজন আসছে বলে অনেকে মনে করে। রাজনৈতিক দলগুলো যতোদিন ভোগবাদী রাজনীতি করবে ততদিন ফ্যাসিবাদী আচরণ শেষ হবে না। জনগণ হচ্ছে ফ্যাসিবাদের ভিকটিম।

বিচার ব্যবস্থা বলতে সাধারণ অর্থে বাংলাদেশের ফৌজদারী ও দেওয়ানি বিচারকে বোঝায়। রাষ্ট্রীয় বিদ্যমান আইন-কানুন ব্যবহার করে বিচার বিভাগ পরিচালিত হয়। বিচার প্রক্রিয়ায় নানা অনুষঙ্গ বা উপাদান থাকে। সরকার চলে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমানে কোন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি নাই। জুলাই আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে অধিকাংশ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন দ্বারা পরিচালিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ চালাচ্ছে যাদের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্র সংস্কার করা। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান সমূহ সঠিকভাবে কার্যকর না থাকায় সেসব প্রতিষ্ঠান যেমন নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার বিভাগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন পুলিশসহ সব সেক্টরে সংস্করণ না পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট কোন সরকার বা ফ্যাসিস্টকে তোষণ করা সরকার যেন ক্ষমতায় না আসে সে লক্ষ্য কাজ করে যাওয়া। কিন্তু সেটা কতটুকু সম্ভব তা সময় বলে দিবে। ততক্ষণে ছাত্র জনতার উচিত হবে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার সাথে মিলিয়ে কেউ যেন মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরপরাধ ও নিরীহ মানুষকে হয়রানি না করে এবং মামলা বাণিজ্য করার সুযোগ না পায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। 

যাইহোক, চাচাকে যে আইনী পরামর্শ দিয়েছিলাম মিথ্যা ও হয়রানিকর মামলা থেকে বাঁচতে সেটা পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি।

 মিথ্যা মামলা হলে যা করবেন তাহলো প্রথমে মামলাটি থানায় নাকি আদালতে হয়েছে তা জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইনি সহায়তা নিতে আইনজীবীর মাধ্যমে মামলার কপি সংগ্রহ করতে হবে।

তৃতীয়ত জামিনের বিষয় অগ্রগামী হওয়া যেমন মামলা জামিনযোগ্য হলে নিম্ন আদালতে জামিন চাহতে হবে, নয়তো উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের জন্য আবেদন করতে হবে। চতুর্থত, আদালতে হাজিরা সংক্রান্ত  নির্দিষ্ট তারিখে হাজিরা দিতে হবে, না হলে জামিন বাতিল হতে পারে।

মিথ্যা মামলা মোকাবিলা করতে যা করা যায় তাহলো- এজাহারের কপি সংগ্রহ করতে হবে। থানায় মামলা হলে এজাহারের কপি সংগ্রহ করে আইনজীবীর সাথে আলোচনা করুন এবং জেলা আদালতে জামিন চাইতে পারেন। অতঃপর চার্জশিট হলে জেলা বা উচ্চ আদালতে জামিন চাইতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে হবে। যদি গ্রেফতার হয়ে থাকে তখন গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে জামিনের আবেদন করতে হবে। পঞ্চমত এরপর আসে আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণের বিষয়। আদালত থেকে সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেলে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তি কি তা অনেকে জিজ্ঞেস করে থাকে। মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ফৌজদারি অপরাধ। এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। দণ্ডবিধির ২১১ ধারা মতে মিথ্যা মামলার জন্য দুই বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। মিথ্যা মামলায় যদি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তাহলে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে।

মিথ্যা মামলা হলে বৃদ্ধ চাচা আরও বৃদ্ধ হবে মামলাবাজরা সুযোগ নিয়ে রাতারাতি টাকার পাহাড় গড়বে এবং আবার যখন ক্ষমতার পালাবদল ঘটবে তখন এখন যারা জুলুম হামলা মামলা দিচ্ছে তারাও পতিত হাসিনা সরকারের মতো লাপাত্তা হয়ে যাবে আর এভাবে চলতে থাকবে এ বঙ্গ জনপদ ও জনপদের মানুষ। মাসদার হোসেন মামলার আলোকে বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন হলে, পৃথক প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু হলে এবং স্বতন্ত্র তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে আলাদা পুলিশিং সিস্টেম কার্যকর হলে হয়রানিমূলক মামলা কমবে বলে বিশ্বাস করা যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার করা অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে তো হবেই পাশাপাশি মামলা বাণিজ্য কমাতে প্রতিহিংসার রাজনীতি রোধ করতে সর্বাগ্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে হবে। মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে প্রমাণিত হলে শাস্তি সহ বিদেশের বিচার ব্যবস্থার মতো অধিক জরিমানা আরোপ করতে বিদ্যমান আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। 

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন