সাজসজ্জার নামে রাষ্ট্রের ক্ষতি, দুদকের জালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হামিদ
অনলাইন ডেস্ক :
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:০৮ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে নিজ ভবন সংলগ্ন এলাকায় সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যবর্ধনের নামে রাষ্ট্রের ২৪ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ উঠেছে। শুধু অভিযোগ নয়, যাচাই-বাছাই শেষে তা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশের ইতিহাসে সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসাবে প্রথম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। শুধু অভিযোগ নয়, তাকে মামলা এবং শেষে সাজাও ভোগ করতে হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হিসাবে আবদুল হামিদ হচ্ছেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের মুখোমুখি হচ্ছেন।
জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিকুঞ্জ-১ আবাসিক এলাকায় সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প বাবদ আবদুল হামিদ রাষ্ট্রের ২৪ কোটি টাকা ক্ষতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। এমন অভিযোগে এরইমধ্যে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান টিম কাজও শুরু করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদক কখনই ব্যক্তির পরিচয় দেখে তার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করে না। এখানে দেখার মূল বিষয় হলো, অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠতা এবং তা দুদকের তফসিলভুক্ত কিনা। সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যেকোনো দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কমিশন।
জানা গেছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকা নিকুঞ্জের লেকড্রাইভ রোডের ৬ নম্বর প্লটে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের তিন তলাবিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে। যেখানে তিনি রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষে উঠেছিলেন। যদিও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর সেই বাসা ছেড়ে দেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের তিন তলাবিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি অভিযোগ রয়েছে, আবদুল হামিদ তার ওই আবাসিক ভবনের দুই পাশের রাস্তা হাঁটার (ওয়াকওয়ে) জন্য বাঁধিয়েছেন। নান্দনিক ডিজাইনে তৈরি ডেক ও ঝুলন্ত ব্রিজ থেকে শুরু করে খালসংলগ্ন রাস্তায় অত্যাধুনিক ল্যাম্প পোস্ট সবই তৈরি করা হয়েছিল তার সুবিধার কথা বিবেচনায়। প্রকল্পের অংশ না হলেও, পূর্বাচল নতুন শহর ঘিরে একশ ফুট চওড়া খাল খনন প্রকল্পের আওতায় খালটি সংস্কার করা হয়। রাজউকের তত্ত্বাবধানে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। যেখানে রাষ্ট্রের ২৪ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়।
জানা যায়, রাষ্ট্রপতি হিসাবে বঙ্গভবনে ১০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়ে ২০২৩ সালের এপ্রিলে আবদুল হামিদ সপরিবারে নিকুঞ্জের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এরপর এলাকাটি রীতিমতো নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে ফেলা হয়। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া সাধারণের প্রবেশে ব্যাপকভাবে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। তবে পট পরিবর্তনের পর আলোচিত বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত হয়ে রয়েছে।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এমপি কোটায় নিকুঞ্জ-১ (দক্ষিণ) আবাসিক এলাকায় প্লট বরাদ্দের আবেদন করেন আবদুল হামিদ। সে অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের ৫ অক্টোবর তাকে তিন কাঠা আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে ২০১১ সালে সেখানে বাড়ি নির্মাণের জন্য তিনি নকশা অনুমোদন নেন। মোট সাড়ে চার লাখ টাকায় প্লট রেজিস্ট্রি করেন আবদুল হামিদ।
রাজউক ও দুদক সূত্রে জানা যায়, নিকুঞ্জ-১ এলাকায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছাড়াও আওয়ামী দোসর হিসাবে পরিচিত আরও অনেকের বাড়ি রয়েছে। হাসিনা সরকারের একাধিক এমপি-মন্ত্রীসহ দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা এবং হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ীদের অনেকেই ওই এলাকায় চোখ ধাঁধানো ডিজাইনের বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তাদের মধ্যে হামিদের বাড়ির পাশেই সাত নম্বর প্লটে বাড়ি করেছেন পলাতক সাবেক হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন। চার নম্বর রোডের তিন নম্বর বাড়ির মালিক হাসিনার আত্মীয় মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত। এছাড়া শেখ হাসিনার সাবেক প্রেস সেক্রেটারি নাঈমুল ইসলাম খান, সাংবাদিক নেতা ও হাসিনার সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা ডিবি হারুনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার হোসেন, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর ব্যাপারী, শেখ পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য এবং দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও বিমা খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী কবির হোসেন ওরফে শেখ কবির এবং সুইডেন আওয়ামী লীগের নেতা বিতর্কিত ব্যবসায়ী কাজী শাহ আলম ওরফে ফুল শাহ আলম নিকুঞ্জ এলাকায় বাড়ি করেছেন। যেখানে রয়েছে অত্যাধুনিক পাশ্চাত্য নির্মাণশৈলীতে তৈরি সারি সারি ডুপ্লেক্স বাড়ি। সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসাবে যারা প্রভাবশালী তাদের বেশিরভাগই এখন পলাতক বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসাবে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দুর্নীতির মামলা ও সাজার মুখোমুখি হয়েছিলেন। গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ১৪ এপ্রিল দুর্নীতি দমন ব্যুরো তেজগাঁও থানায় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে বিচারে এরশাদকে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ২০০০ সালের ২০ নভেম্বর বিচারক তাকে সাত বছরের কারাদণ্ডের রায় দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। পরে এরশাদের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সাজা কমিয়ে পাঁচ বছর করেন এবং ৫৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। ওই রায় রাজনৈতিক ও আইন অঙ্গনে একটি ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করেছিল।



