বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ভারতের উদ্বেগ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৫ এএম
বাংলাদেশে তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে আবারও জনমত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নদীটির পানিবণ্টন চুক্তি ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। সম্প্রতি লালমনিরহাটে বিএনপির আয়োজনে অনুষ্ঠিত তিস্তা বাঁচাও মশাল সমাবেশে অংশ নেয় হাজারো মানুষ। এদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য উইক জানিয়েছে, বাংলাদেশে তিস্তা ইস্যুতে বাড়তে থাকা জনচাপে ভারত অস্বস্তিতে পড়েছে।
গত ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত শিক্ষার্থী শহীদ মিনারের সামনে মশাল জ্বেলে মানববন্ধন করে তিস্তা মাস্টারপ্ল্যান অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবি জানান। তাদের মতে, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে নতুন এক বিপ্লব ঘটবে।
এই আন্দোলন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন ধরেই তিস্তা নদী—৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এক আন্তসীমান্ত জলধারা—বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। একসময় কৃষির প্রাণ ছিল এই নদী, এখন তা পরিণত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের প্রতীকে।
তিস্তা উৎপন্ন হয়েছে পূর্ব হিমালয়ের পাওহুনরি পর্বত থেকে। এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগে প্রবেশ করে এবং শেষে যমুনা নদীতে মিশে যায়। বাংলাদেশের ছয়টি উত্তরাঞ্চলীয় জেলায় কয়েক লাখ কৃষক শুকনো মৌসুমে পানির ঘাটতিতে ভুগছেন। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইএফপিআরআই) জানিয়েছে, পানির স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন ধান উৎপাদন হারাচ্ছে।
অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জন্য তিস্তা সেচ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ। গজলডোবা ব্যারাজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯৮৩ সালে তিস্তা নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১১ সালে নতুন একটি পানিবণ্টন চুক্তির আশা জেগেছিল—যেখানে বাংলাদেশের জন্য সাড়ে ৩৭ শতাংশ পানি বরাদ্দের কথা বলা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের কৃষকদের স্বার্থে আপত্তি জানালে চুক্তি আর এগোয়নি। এরপর থেকে কার্যত স্থবির হয়ে আছে আলোচনা।
এদিকে বাংলাদেশের জনগণের চাপ বাড়তে থাকায় সরকার তিস্তা প্রকল্পে চীনের সহায়তা নেওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে। ২০২৫ সালের মার্চে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বেইজিং সফরে গিয়ে তিস্তা নদী পুনর্বাসন ও অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করে ৫০ বছরের একটি মাস্টারপ্ল্যান হাতে পান। চীন প্রকল্পে ঋণ, অনুদান ও বিনিয়োগ মিলিয়ে ২১০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার ঘোষণা দেয়।
চীন-বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, *তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট* (টিআরসিএমআরপি)–এর আওতায় নদী খনন, জলাধার নির্মাণ, সড়ক ও স্যাটেলাইট শহর উন্নয়ন করা হবে। এছাড়া, দুই দেশ ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানিবিজ্ঞান সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা নতুন দিল্লিকে আরও সতর্ক করে তুলেছে।
ভারতের কাছে তিস্তা এখন শুধু পানির নয়, বরং নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতির প্রশ্ন। প্রকল্প এলাকা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জীবনরেখা বলে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডর বা ‘চিকেনস নেক’-এর খুব কাছাকাছি অবস্থিত। মাত্র ৬০ কিলোমিটার লম্বা ও ২২ কিলোমিটার চওড়া এই পথ ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ফলে, ভারতের আশঙ্কা—চীনের কোনো উপস্থিতি সেখানে কৌশলগত ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
সম্প্রতি লালমনিরহাট বিমানঘাঁটিতে নতুন কার্যক্রম দেখা গেছে, যা নিয়ে জল্পনা ছড়ালেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চীনের উপস্থিতির খবর অস্বীকার করেছে। তবে ভারতীয় বিশ্লেষক ব্রহ্ম চ্যালানি সতর্ক করে বলেছেন, যদি চীন ওই অঞ্চলে কার্যত প্রবেশাধিকার পায়, তাহলে ভারতের সামরিক অবকাঠামো পর্যবেক্ষণের ঝুঁকি তৈরি হবে।
একই সময়ে চীনের ব্রহ্মপুত্রের উজানে বিশাল বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প নিয়েও উদ্বিগ্ন ভারত। বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এই ইস্যুটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিএনপি তিস্তা ইস্যুকে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ভারতের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতার অভিযোগ বাড়ছে।
এদিকে ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হতে যাচ্ছে—যার আগে তিস্তা নিয়ে জাতীয় বিতর্ক আরও তীব্র আকার নিচ্ছে।



