Logo
Logo
×

বিশেষ সংবাদ

ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে সারা দেশে, নিয়ন্ত্রণ কেবল শহরে!

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক :

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১১:১৪ এএম

ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে সারা দেশে, নিয়ন্ত্রণ কেবল শহরে!

ছবি - সংগৃহীত

একসময় যাকে বলা হতো ‘শহুরে রোগ’, সেই ডেঙ্গু এখন শহরের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। চলতি ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকার বাইরের অর্থাৎ গ্রাম ও মফস্বল এলাকায়। অথচ প্রতিরোধ পরিকল্পনা, জরিপ, ও নজরদারি— সবই সীমাবদ্ধ রাজধানী ও কিছু নগর ঘিরে।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে গ্রামীণ এলাকায় ডেঙ্গুর বিস্তার পাঁচগুণ বেড়েছে। তবে, এটি এবার গ্রামে বেশি আতঙ্ক ছড়ালেও প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখনও মূলত নগরকেন্দ্রিক, বিশেষ করে ঢাকা শহর ঘিরে। ফলে একদিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও অন্যদিকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে ডেঙ্গু রোগীর ভৌগোলিক বিস্তারে পরিবর্তন ঘটেছে। ২০২১ সালেও যেখানে ডেঙ্গু ছিল মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক— সেবার রোগীর ৮৩.০৭ শতাংশই রাজধানীতে ছিল। সেই চিত্র এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ২০২২ সালে ঢাকার রোগীর হার কমে দাঁড়ায় ৬২.৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে, ঢাকার বাইরের রোগী বেড়ে হয় ৩৭.১৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো রাজধানীর বাইরে রোগীর সংখ্যা ঢাকাকে ছাড়িয়ে যায়। সেবার ঢাকায় ছিল ৩৩.৮৫ শতাংশ, আর ঢাকার বাইরে ছিল ৬৬.১৫ শতাংশ।

২০২৪ সালে এ পার্থক্য আরও বেড়ে দাঁড়ায় ঢাকায় ৩৯.৩০ শতাংশ এবং ঢাকার বাইরে ৬০.৭০ শতাংশ। এমনকি চলতি বছরের (২০২৫ সাল) ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত (৩০ জুন) দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ১০ হাজার ২৯৬ জন। এর মধ্যে আট হাজার ৬২ জন (৭৮.৩ শতাংশ) রোগীই রাজধানী ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগ থেকে শনাক্ত হয়। অন্যদিকে, রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় শনাক্ত হন দুই হাজার ২৩০ জন (২১.৭ শতাংশ) রোগী।

পরিসংখ্যান বলছে, পাঁচ বছরে ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বাইরে পাঁচগুণ বেড়েছে। অথচ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সরকারি পরিকল্পনা ও মনোযোগ এখনও ঢাকাকেন্দ্রিক রয়ে গেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি গ্রামীণ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নেওয়া না হয়, তা হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছর ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের সর্বাধিক সংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়েছেন বরিশাল বিভাগে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগের সিটি কর্পোরেশনের বাইরের এলাকাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন চার হাজার ৫৯১ রোগী, যা দেশের সব বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের সিটি কর্পোরেশনের বাইরের এলাকা থেকে শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৫২৬ জন। ঢাকা বিভাগের বাইরের অংশেও এক হাজার ৮ রোগী পাওয়া গেছে।

রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনেও রোগীর সংখ্যা কম নয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এক হাজার ৪০৩ জন, আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৮৩১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। খুলনা বিভাগের বাইরে ৩৪৩, রাজশাহীতে ৪০১, ময়মনসিংহে ১৩৬, সিলেটে ৩০ এবং রংপুর বিভাগে মাত্র ২৬ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।

গত এক সপ্তাহের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, গত ২৪ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে যথাক্রমে ১৫৭, ১১৮, ৭৪, ১০৭, ১৪১, ১৩৬ ও ১৪৮ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে গত এক সপ্তাহে যথাক্রমে ৫৮, ৪৩, ৮, ১১, ৪০, ৫৫ ও ৫৭ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। রাজশাহীতে গত এক সপ্তাহে যথাক্রমে ৪৪, ২৯, ১৮, ৬, ৩৩ ও ৫৪ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া খুলনা বিভাগে ৮, ১৬, ৬, ৪১ ও ২১ জনের; ময়মনসিংহ বিভাগে ৫, ২, ৬  জনের; সিলেট বিভাগে ১, ৩, ২ ও ৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।

এছাড়া গত এক সপ্তাহে ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) যথাক্রমে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ৩৫, ৪৩, ৩০, ১২, ১৮, ৪৮ ও ৬১ জনের। সেইসঙ্গে এই সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ৫০, ৪৫, ৩২, ৬, ৪০, ২৮ ও ৪৫ জনের এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে যথাক্রমে ৪২, ২৬, ২৪, ১৫, ৮, ৩২ ও ৪২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।

চলতি বছর ঢাকার বাইরে তিন সিটি কর্পোরেশন এলাকা এবং ছয় জেলায় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার উপস্থিতি জানতে জরিপ করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। জরিপে একটি মাত্র জেলা বরগুনার গ্রামাঞ্চলেও এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। অন্য জেলা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায়ও জরিপ হয়।  

বরগুনা জেলার জরিপে পৌর এলাকায় ৩১ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলের ৭৬ শতাংশ বাড়িতে এডিসের লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া যায়। এর বাইরে  মাগুরার পৌর এলাকায় ৩৫.৫৬ শতাংশ, ঝিনাইদহে ৩২.৯৬ শতাংশ, পটুয়াখালীতে ১৮.১৫ শতাংশ, পিরোজপুরে ১৪.৪৪ শতাংশ এবং কুষ্টিয়ার পৌর এলাকার ৭.২৯ শতাংশ বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়।

লার্ভা পাওয়ার শতকরা হার বা হাউজ ইনডেক্স ১০-এর বেশি হলে মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বিবেচনা করা হয়।

সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ধারণা করা হয়, আগামী ৩০-৪০ বছর ডেঙ্গু হতে থাকবে। কারণ, ঢাকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সীমিত আকারে কিছু উদ্যোগ রয়েছে। ঢাকার বাইরে মশার নিয়ন্ত্রণ বা অন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ নেই বললেই চলে। এর মধ্যে আবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিধি না থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।’

ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। এরপর গত ২৫ বছরে আমরা ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আরও যে কত বছর লাগবে সেটাও জানা নেই। ঢাকার বাইরে পাঁচগুণ মানুষ বসবাস করেন। সুতরাং, মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রোগটি আগামী ৩০ বছর থাকবে, এটা খুব সহজে অনুমান করা যায়।

শহর ছেড়ে কেন গ্রামে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু— এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, ‘এডিস ইজিপ্টি ও অ্যালবোপিকটাস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। ইজিপ্টি শহর এবং অ্যালবোপিকটাস গ্রামাঞ্চলের মশা। অ্যালবোপিকটাস মশা বন-জঙ্গল, বাঁশের ঝাড়, গাছের বাকলের মতো স্থানে থাকে। এ মশা আগে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল না। এখন তারাও ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে। আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীকে কামড় দিয়ে তারাও ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। একইসঙ্গে নগরে ডেঙ্গু ছড়ানো ইজিপ্টি মশা যে কোনোভাবে গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। এখন দুই প্রজাতির মশাই সমান তালে ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে। এছাড়া বিরূপ পরিবেশেও টিকে থাকার (অভিযোজন) সক্ষমতা তৈরি করছে এসব মশা।

ড. গোলাম ছারোয়ারের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সঠিক ‘কন্টাক ট্রেসিং’ (রোগী ও তার অবস্থান শনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা) অতি জরুরি। কিন্তু এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে মশা নির্মূলের উদ্যোগ নেই। সে কারণে অন্য কোনো অঞ্চল থেকে আক্রান্ত হয়ে এলেও রোগী যেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছেন, সেই জায়গার তালিকা করা হচ্ছে। এতে আক্রান্ত মশাকে আড়াল করে তাদের বংশবিস্তারের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন জানান, সুপেয় পানির সংকটের কারণে বরগুনা জেলায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার প্রচলন আছে। আর এডিস মশার লার্ভা তৈরি হয় জমিয়ে রাখা পরিষ্কার পানিতে। এসব পানির আধারই হলো এডিসের বিস্তারের বড় ক্ষেত্র। বাড়িতে রাখা প্লাস্টিকের ড্রামের পানি ঢেকে রাখা হয় কাপড় দিয়ে। এটার চর্চা গ্রামে বেশি। এসব কাপড়ে ব্যাপক মাত্রায় লার্ভা পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ঢাকার বাইরে বরগুনার পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। এ পরিস্থিতি যে শুধু বরগুনার গ্রামে, তা এখন বলা যায় না। দেশের অন্যত্রও যদি জরিপ করা হয়, তবে এমন বা এর কাছাকাছি চিত্র পাওয়া যেতে পারে।

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন