বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবির-ছাত্রদল মুখোমুখি?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৮ এএম
ছবি : সংগৃহীত
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতির চেহারা কেমন হবে সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে দেখা গেছে বিএনপি এবং জামায়াতের ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের।
ঘটেছে সংঘর্ষের ঘটনাও। কিন্তু ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের যে দাবি উঠেছিল তার বাস্তবায়ন কতদূর সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আবার সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতি আবারো পুরনো চেহারা নিয়ে হাজির হবে কি না সে ভয়ও আছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে আসে ছাত্রশিবির। তিন সদস্যের আংশিক কমিটি নিয়ে প্রকাশ্যে আসার পর গত ১৯শে নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি সর্বদলীয় মতবিনিময় সভায় অংশ নেয় সংগঠনটি। সভাটি ডেকেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উদ্দেশ্য ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা। কিন্তু সভা শুরুর কিছুক্ষণ পরই ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি নিয়ে হট্টগোল শুরু হয়। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে প্রথম আপত্তি তোলা হয়। পরে কয়েকটি বাম সংগঠনও এতে যোগ দেয়।
আবার ছাত্রশিবিরের পক্ষেও বক্তব্য রাখে কয়েকটি সংগঠন। পক্ষে-বিপক্ষে, পাল্টা-পাল্টি স্লোগানে একপর্যায়ে বৈঠক পণ্ড হয়ে যায়। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রশিবির আত্মপ্রকাশ করার পর সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা গিয়েছিল ছাত্রদলকে।
শিবিরের বিরোধিতা কেন করছে ছাত্রদল?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিনের সভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আহ্বানে যোগ দিয়েছিলেন ছাত্রদলের পদপ্রত্যাশী রিফাত মাহমুদ। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, আমরা বলেছিলাম, শিবির এই ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত। বাইশটা ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন তাদেরকে নিষিদ্ধ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগও আছে। সেই প্রেক্ষাপটে আমরা বলেছি যে তাদের সঙ্গে থাকবো না। তখন আমরা ওয়াকআউট করি, সেখান থেকে চলে আসি।
শিবিরকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে সবার আগে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে বলে মনে করেন রিফাত। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি তারা যে তিনজনের কমিটি দিয়েছে, সেটাই তাদের কমিটি না। এর বাইরেও তাদের হয়তো লোক আছে। এখন তারা গুপ্ত রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসুক আগে। তাদের অবস্থান, কর্মসূচি তাদেরকে আমাদের কাছে তুলে ধরতে হবে। তারপর ছাত্রসংগঠনগুলো, সাধারণ ছাত্র এবং প্রশাসন বিবেচনা করবে তাদের রাজনীতি এখানে চলবে কি চলবে না।
তবে শিবির ইস্যুতে সাময়িক উত্তেজনা থাকলেও জাহাঙ্গীরনগরে মোটাদাগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখা গেছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টি ঘুরে সেখানে শিবিরের নেতা-কর্মীদের অবস্থানও দেখা গেছে। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনো দিতে পারেনি সংগঠনটি।
অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল সক্রিয় থাকলেও তাদের কোনো কমিটি নেই। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন অবস্থায় আছে ছাত্র সংগঠনটি। তবে ক্যাম্পাসে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশ সুরক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া বেশ সক্রিয় আছে বাম সংগঠনগুলোও।
অন্যদিকে ছাত্রশিবিরও চেষ্টা করছে পূর্ণ সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে হাজির হতে। কিন্তু বিরোধিতার মুখে সেটা কতটা সম্ভব? জানতে চাইলে ছাত্রশিবিরের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি মহিবুর রহমান অবশ্য বলেন, খুব শিগগিরই পূর্ণ কমিটি নিয়ে সামনে আসার চেষ্টা করছেন তারা।
তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে ছিলাম না। সে অবস্থা থেকে সামনে আসতে একটু সময় লাগবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু বিরোধিতার মুখে শিবির কতটা সুবিধা করতে পারবে?
তিনি বলেন, দেখেন এখানে মোটাদাগে সবাই যে আমাদের বিরোধিতা করছে এমনটা না। কয়েকজন বিরোধিতা করছে, বাকিরা আমাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে। কারণ রাজনীতি করার অধিকার আমাদের আছে। এখানে কোনো একটা সংগঠন যদি আরেকটা সংগঠনের সঙ্গে বসতে না চায়, তাহলে তারা কি রাজনীতি করতে পারবে না?
তিনি বলেন, রাজনীতি করার অধিকার তো কোনো সংগঠন অন্য সংগঠনকে দিতে পারে না। কারণ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কে রাজনীতি করতে পারবে, কে পারবে না সেটা তো বলে দেয়ার বৈধ কাঠামো আছে। এখানে সিনেট আছে, সিন্ডিকেট আছে, একাডেমিক কাউন্সিল আছে। তারা তো আমাদেরকে নিষিদ্ধ করেনি। এখন এর বাইরে তো কেউ কাউকে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে না।
শিবির-ছাত্রদল কি মুখোমুখি হচ্ছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে আসার পর এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল কয়েকটি বাম সংগঠন। পরে ছাত্রদলও নানা প্রশ্ন তুলেছে এটা নিয়ে।এই ইস্যুতে দুই দলের কর্মী-সমর্থকদেরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পাল্টা-পাল্টি পোস্ট দিতে দেখা যায়।
এরমধ্যেই গত ৭ই নভেম্বর ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’ উপলক্ষে বিএনপির দলীয় পোস্টার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে সাঁটিয়ে দেয় ছাত্রদল। তবে হলগুলোতে পোস্টার লাগানোর পর ছাত্রদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলে রাতেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল হয় সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে। কার্যক্রমের শুরতেই এমন বিরোধিতা বেশ বেকায়দায় ফেলে ছাত্রদলকে। ছাত্রদল এর পেছনে শিবিরকে দায়ী করলেও শিবির অবশ্য সেটা অস্বীকার করেছে।
তবে এমন পরিস্থিতি শুধু ঢাকায় নয়, আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও দেখা যায়। বিশেষ করে চট্টগ্রামে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ছাত্রদল-ছাত্রশিবির সংঘর্ষ কিংবা মুখোমুখি অবস্থানের খবর দিচ্ছে গণমাধ্যমগুলো। ফলে ক্যাম্পাসগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তবে ছাত্রদল-শিবির মুখোমুখি অবস্থানে আছে এমনটা মনে করছেন না শিবির কিংবা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা।
তাহলে বিরোধিতা কেন তৈরি হচ্ছে এমন প্রশ্নে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির অবশ্য অভিযোগ করছেন, ছাত্রদলের বিরুদ্ধে ‘নামে-বেনামে প্রোপাগান্ডা ছাড়াচ্ছে শিবির’। তিনি বলেন, পাঁচই আগস্টের পরে তারা আত্মপ্রকাশ করেছে। আত্মপ্রকাশ করেই ছাত্রদলের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে প্রোপাগান্ডা তৈরি করছে। এর মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তারা আমাদের একটা বিভেদ তৈরি করতে চায়। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ঠিক এ চেষ্টাই তারা করেছে। তারা সেখানে হল দখল করেছে। কিন্তু ছাত্রদলের ছেলেরা যখন হলে উঠতে গিয়েছে, তারা সেখানে বাধা দিয়েছে।
তবে শিবির অবশ্য এমন অভিযোগ অস্বীকার করছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম বলেন, ছাত্রশিবিরের কারণে কোথাও সংঘর্ষ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, আপনি যদি বলেন ছাত্রশিবিরের কারণে সংঘর্ষ হচ্ছে, তাহলে এটা তো তথ্য-প্রমাণহীন একটা পারসেপশন থেকে বলা হলো। আমরা যেটা প্রত্যাশা করি, আমরা একসঙ্গে সবাই বসতে পারি, আলোচনা করতে পারি।
তিনি বলেন, প্রত্যেকটা ক্যাম্পাসেই নিজস্ব প্রশাসনিক নিয়ম-কানুন রয়েছে। সেটার আলোকেই ছাত্ররা হলে সিট পাবে এবং তাদের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে এটাই আসলে ছাত্রশিবির প্রত্যাশা করে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আলোচনায় এক প্লাটফর্মে শিবিরসহ সব সংগঠন
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিষয়টি আলোচনায় ওঠে মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের ভূমিকার কারণে। পরে এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফা দাবির মধ্যেও স্থান পায়। তবে ছাত্র রাজনীতি বন্ধে কোনো উদ্যোগ পরে আর দেখা যায়নি। বরং ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম জোরালো করছে।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছে, তারা কখনোই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চাননি। তাদের দাবিতে বলা হয়েছে ‘লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি’ বন্ধের কথা। কিন্তু এর অর্থ আসলে কী? এর ফলে কি বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল সমর্থিত যেসব ছাত্রসংগঠন রয়েছে তাদের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হচ্ছে?
জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, তারা ছাত্র রাজনীতির সংস্কারের পরিবর্তন চান। দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখে আসছি, মূল কোনো একটা রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের নির্দেশনায় ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি পরিচালিত হয়ে থাকে। তারা যে কর্মসূচি দেয়, সেই ছাত্র সংগঠনগুলোও ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তি হিসেবে সেই কর্মসূচি পালন করে। আমরা এই কালচার বন্ধ করার কথা বলছি। এর জন্য একটা রূপরেখা দরকার।
তিনি বলেন, নব্বই পরবর্তীকালের লেজুড়বৃত্তিক কালচার থেকে ছাত্র রাজনীতিকে বের হয়ে আসতে হবে। তারা ছাত্রদের জন্য কাজ করবে। তারা কোনো দলকে ক্ষমতায় নেয়ার জন্য বা টেকানোর জন্য কাজ করবে না। আমরা এখন এরকম একটা রাজনৈতিক রূপরেখা সব ছাত্রসংগঠনগুলোর সমন্বয়ে তৈরি করতে চাই।
মাসউদ যে নতুন রাজনৈতিক রূপরেখার কথা বলছেন, তা নিয়ে অবশ্য ইতোমধ্যেই ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে বসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।আদর্শিক বিরোধিতা এবং মতপার্থক্য সত্ত্বেও এরকম বৈঠকে ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা একসঙ্গে বসছেন। তাদের মধ্যে মতবিনিময়ও হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কেমন থাকে সেটা এখনো একটা বড় প্রশ্ন।
সূত্র : বিবিসি বাংলা