বড় দলের ছায়া পেরিয়ে নতুন পথের খোঁজে এনসিপি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০২ পিএম
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সরব হয়ে উঠেছে। বড় দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনি প্রস্তুতি জোরদার করেছে, আর ছোট দলগুলো মাঠ গোছানো ও জোট গঠনের উদ্যোগে ব্যস্ত। এই প্রেক্ষাপটে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) রাজনৈতিক মহলে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। তরুণ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে গঠিত দলটি নির্বাচনি মাঠে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চাইলেও, সাংগঠনিক সংকট ও প্রশাসনিক অনাস্থা তাদের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন প্রজন্মের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা এনসিপি ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে চায়। তবে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে দলের মধ্যে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। এনসিপির নেতারা অভিযোগ করছেন, সরকার পরিবর্তনের পর বিএনপি ও জামায়াত নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তাদের জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বসিয়েছে, যাতে তারা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের সহায়তা করতে পারে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, দেশের বড় দলগুলো ইতোমধ্যে পেশিশক্তির ব্যবহার শুরু করেছে। প্রশাসনের একটি অংশ তাদের হয়ে কাজ করছে। এনসিপির প্রার্থীরা নিয়মিত হুমকি পাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ‘জুলাই সনদ’, ‘পিআর ব্যবস্থা’ ও গণভোট ইস্যুতে টানাপোড়েনে রয়েছে এনসিপি। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব ও সংস্কারপন্থি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের শক্তি হলেও, দলটি এখনো তৃণমূলে স্থায়ী ভিত্তি গড়ে তুলতে পারেনি।
সম্প্রতি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা কোনো রাজনীতিকের ছায়াতলে নয়, নিজস্ব আদর্শে নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। জনগণের অংশগ্রহণই আমাদের আসল শক্তি।
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে এনসিপি। তাদের অভিযোগ, কমিশন গঠনে বড় দলের প্রভাব ছিল, যা প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে। এনসিপি শুরু থেকেই ‘শাপলা’ প্রতীক চাইলেও, ইসি তাদের দিয়েছে ‘শাপলার কলি’। দলটি এটিকে রাজনৈতিক পক্ষপাতের নিদর্শন হিসেবে দেখছে।
মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ইসির আচরণ স্বেচ্ছাচারী। আমরা কি প্রতীক নিয়ে পড়ে থাকব, নাকি নির্বাচনি প্রস্তুতিতে নামব? আমরা বৃহত্তর স্বার্থে এগিয়ে যাচ্ছি।
নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি সম্প্রতি কিছু অভ্যন্তরীণ বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছে। কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে অনৈতিক আর্থিক লেনদেন ও অসদাচরণের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শীর্ষ নেতৃত্ব বলছে, তারা দলকে পরিচ্ছন্ন রাখতে চান এবং যেকোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে কঠোর অবস্থান নেবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও এনসিপির উপস্থিতি এখনো দুর্বল। ডাকসু ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে এনসিপি-সমর্থিত প্যানেলের ভরাডুবি দলটির অভ্যন্তরে আত্মসমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ছাত্র সংগঠন পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। ২৩ অক্টোবর ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘জাতীয় ছাত্রশক্তি’, যার নতুন নেতৃত্বে রয়েছেন জাহিদ আহসান ও আবু বাকের মজুমদার।
সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে দলটি তৃণমূলে কাজ বাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে ৫৫টি জেলা, ৬টি মহানগর, ৩৩০টি উপজেলা ও ২টি পৌরসভায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারা নিয়মিত বিভাগীয় সফরে যাচ্ছেন এবং স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় সভা করছেন।
দলটি ‘কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি’ও গঠন করেছে, যার নেতৃত্বে আছেন মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সেক্রেটারি ডা. তাসনিম জারা। কমিটির দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে প্রার্থী বাছাই, প্রচারণা, মাঠ পর্যায়ের সমন্বয়, এবং আইনি ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি।
জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে আমরা প্রার্থীর সাংগঠনিক সক্ষমতা, জুলাই অভ্যুত্থানে ভূমিকা এবং বাংলাদেশের প্রতি কমিটমেন্ট মূল্যায়ন করছি। তরুণদের অগ্রাধিকার দিচ্ছি।
এনসিপি এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও, রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুযায়ী বড় দলের সঙ্গে জোটের সম্ভাবনাও খোলা রেখেছে। আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, সংস্কারের পক্ষে কেউ না থাকলে আমাদের সঙ্গে জোট সম্ভব নয়। মৌলিক দাবি মিললেই সমঝোতা বিবেচনা করব।
দলের যুগ্ম সদস্যসচিব মুশফিক উস সালেহীন বলেন, আমরা এককভাবে লড়তে প্রস্তুত। তবে রাজনীতিতে কখনও ‘শেষ’ বলে কিছু নেই—পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব।
তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা এনসিপি এখন নির্বাচনি মাঠে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত। প্রশাসনিক অনাস্থা, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও প্রতীক বিতর্কের মতো বাধা সত্ত্বেও দলটির নেতৃত্ব আশাবাদী—তাদের লক্ষ্য, নতুন প্রজন্মের জন্য এক ভিন্নধর্মী গণতান্ত্রিক বিকল্প প্রতিষ্ঠা করা।



