
প্রিন্ট: ০২ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৪৮ এএম
অল্পের জন্য রক্ষা, সকলের জন্য শিক্ষা

বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫, ০৭:০১ পিএম

জনপ্রিয় তারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সম্প্রতি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়া এবং আরোগ্য লাভ করা প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। উদ্বিগ্নতা, প্রার্থনা, স্মৃতিকাতরতায় ছেয়ে যায় গণমানুষের অভিব্যক্তিসমূহ। একই সাথে বেশ কিছু প্রশ্নেরও উদ্রেক করে। একজন লিখেছেন, ‘তামিম ইকবালের মত ৩৬ বছরের, পিক ফর্মে থাকা অ্যাথলেটের যদি ১০০% ব্লক থাকে, যেজন্য হার্টই বন্ধ হয়ে যায়, তবে আপনি সুস্থ আছেন তো?’ আরেকজন লিখেছেন, ‘তামিম এত খেলাধূলা দৌড়াদৌড়ি ব্যায়ামের পর তার হার্ট ব্লক! আমার আর হেঁটে কি হবে? ধর বন্ধু আমার কেহ নাই’। এসব প্রশ্ন বা সংশয়ের উত্তর প্রয়োজন। যে সরল যুক্তির ভিত্তিতে মানুষ বড় ধরণের ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে তা বৈজ্ঞানিকভাবে খণ্ডন করা জরুরি। সেজন্যই কলম ধরা। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে হলে হার্ট, ব্লক, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি সম্বন্ধে মৌলিক কিছু আলোচনা হওয়া দরকার।
প্রথমে হার্টবা হৃদপিণ্ড কী? সাহিত্যের ভাষায় Heart is the most poetic organ of the human body অর্থাৎ ‘হৃদয় হচ্ছে মানবদেহের সবচেয়ে কাব্যিক অঙ্গ’। হার্ট দান করা যায়, তবে কেবল মৃত মানুষের দেহ থেকে। কিডনি হল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দান করা অঙ্গ, তারর্প রয়েছে লিভার এবং চোখের কর্নিয়া; হার্টের ক্রম আরো পরে। তবে পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে নিজের হৃদয় নিজের কাছে রাখতে চায়, প্রত্যেকইে তার প্রিয়জনকে দিয়ে দিতে চায়, বিনিময় শর্ত আছে, গ্রহীতার হৃদয়টাও তার চাই। কেউ তা পায়, কেউ তা পায় না। তাই নিয়ে আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত আবেগ-উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই। এ বিষয়টা সবচেয়ে বেশি জানে কবি-সাহিত্যিকরা, তাই কোন ব্যতিক্রম ছাড়া সকল কবি-সাহিত্যিকের কারবার হচ্ছে হৃদয় নিয়ে। উদাহরণ দিয়ে কূল-কিনারা পাওয়া যাবে না; শুধু একটা উল্লেখ করি। দৃষ্টি-বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী প্রতিভা হেলেন কেলার বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং সেরা জিনিসগুলো দেখা যায় না, এমনকি স্পর্শও করা যায় না - সেগুলো হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।’ বাস্তবে হার্ট হচ্ছে একটি পেশীবহুল অঙ্গ (মুষ্টির আকারের প্রায়) যা মানুষের বুকের কেন্দ্রের সামান্য বাম দিকে অবস্থিত। এটি বস্তুত একটি পাম্পিং যন্ত্রের মত কাজ করে। হার্ট বিট অর্থাৎ সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে সে সারা শরীরে রক্ত পাম্প করে। দেহে আপাদমস্তক জালের মত ছড়িয়ে থাকা রক্তনালীর (শিরা) মাধ্যমে দুষিত (কার্বন ডাই অক্সাইড মিশ্রিত) রক্ত হার্টে জমা হয়, হার্ট তা পাম্প (সংকোচন) করে ফুসফুসে পাঠায়। ফুসফুসে প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংগৃহীত অক্সিজেনের মাধ্যমে ঐ দুষিত রক্ত বিশুদ্ধ (অক্সিজেন মিশ্রিত) হয় এবং হার্টে (প্রসারিত অবস্থায়) ফেরত আসে। হার্ট এরপর পাম্প (সংকোচন) করে এই বিশুদ্ধ রক্ত রক্তনালী (ধমনী) দিয়ে দেহের সব টিস্যু এবং অঙ্গে পৌঁছায়। রক্ত অক্সিজেনের সাথে পুষ্টিও বহন করে; অক্সিজেন ও পুষ্টির মাধ্যমে টিস্যু তথা অঙ্গ তথা শরীর বেঁচে থাকে, নচেৎ মৃত্যুবরণ করে। হার্ট তো অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহের মাধ্যমে শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু ওর নিজেকে তো আগে বেঁচে থাকতে হবে। ওকে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহের কাজটা কে করে থাকে? এ কাজটা করে থাকে করোনারি আর্টারি, যেগুলি হচ্ছে হার্টের নিজস্ব রক্তনালী। করোনারি আর্টারিসমূহ হার্টে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে হার্টকে সচল রাখে।
এখন দেখা যাক, হার্ট অ্যাটাক কী? হার্টকে কে অ্যাটাক মানে আক্রমণ করে? হার্ট অ্যাটাক হৃদপিণ্ডের পেশীর কোনও অংশে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে ঘটে। করোনারি আর্টারিতে কোন ব্লক থাকলে তা অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তকে হৃদপিণ্ডের টিস্যুতে পৌঁছাতে বাধা দেয়, যা হৃদপিণ্ডের পেশীর সেই অংশের ক্ষতি করতে
পারে, এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। ব্লকেজের কারণে হৃদপিণ্ড নিজেই নিজেকে আক্রমণ করে থাকে, এজন্য একে হার্ট অ্যাটাক বলা হয়। সাধারণত করোনারি আর্টারির ভিতরে চর্বি (fatty deposits) জমা হওয়ার কারণে এই ব্লকেজ হয়; ফ্যাটি ডিপোজিটগুলি প্লাক (plaque) তৈরি করে। সময়ের সাথে সাথে প্লাক করোনারি আর্টারির নালীপথকে সংকুচিত করতে পারে, যার ফলে রক্ত প্রবাহ কমে যেতে পারে। যদি প্লাকটি ফেটে যায়, তাহলে এটি এমনভাবে জমাট বাঁধে যা হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রবাহকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয় এবং ফলশ্রতিতে হার্ট অ্যাটাক হয়। এভাবে ধারণা করা যেতে পারে- রান্নাঘরের বেসিন বা সিঙ্কের বর্জ্য (চর্বি)-এর মাধ্যমে আটকে যাওয়া পাইপ (রক্তনালী) দিয়ে পানি (রক্ত) প্রবাহিত হতে পারছে না, তাই বেসিন বা সিঙ্ক (হৃদপিণ্ড) সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় হার্ট অ্যাটাককে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (myocardial infarction) বলে। হার্টের মাংসপেশীকে মায়োকার্ডিয়াম বলে আর ইনফার্কশন বলতে রক্ত সরবরাহের অভাবের কারণে টিস্যুর মৃত্যুকে বোঝায়। যখন মায়োকার্ডিয়ামের কোনও অংশে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তখন আক্রান্ত হৃদপিণ্ডের পেশী অক্সিজেন-বঞ্চিত হয়ে মারা যেতে শুরু করে। এই ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুকে ‘ইনফার্ক্টেড টিস্যু’ বলা হয়। হার্ট অ্যাটাকের সতর্কতাসূচক লক্ষণসমূহ হচ্ছে: বুকে ব্যথা/চাপ (মনে হবে যেন বুকের উপর ভারী পাথর চেপে ধরা হয়েছে), বাহু, চোয়াল বা পিঠে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া, শ্বাসকষ্ট, ঠাণ্ডা ঘাম, বমি বমি ভাব। হার্ট অ্যাটাকের তীব্রতা নির্ভর করে হৃদপিণ্ডের পেশী কতটা ব্লকের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং কত দ্রুত রক্তপ্রবাহ পুনরুদ্ধার করা হয় তার উপর। এখানে আরেকটা ঘটনা ঘটে, সেটা হচ্ছে ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ (cardiac arrest) অর্থাৎ হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া । এটি বৈদ্যুতিক সমস্যা। হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়, যার ফলে তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, এটা হৃৎপিণ্ডে ‘বিদ্যুৎ বিভ্রাটের’ মতো, কারণ রক্ত সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। হার্ট বিট সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মস্তিষ্কে/শরীরে রক্ত পাম্প করা হয় না, নাড়ি (পাল্স) পাওয়া যায় না। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের সতর্কতাসূচক লক্ষণসমূহ হচ্ছে: শরীর হঠাৎ পড়ে যাওয়া (collapse), শ্বাস-প্রশ্বাস না থাকা/হাঁপানি বন্ধ হওয়া, জ্ঞান হারানো (কোন প্রতিক্রিয়া না থাকা)। তাহলে দাঁড়ালো- হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে প্লাম্বিং সমস্যা (রক্তনালী আটকে যাওয়া), আর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হচ্ছে বৈদ্যুতিক ব্যর্থতা (হার্ট বিট বন্ধ হয়ে যাওয়া)। হার্ট অ্যাটাক কার্ডিয়াক অ্যারেস্টকে উস্কে দিতে পারে, কিন্তু দুটো একই বিষয় নয়।
এবারে আসা যাক তামিমের ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল সে প্রসঙ্গে। সেদিন সকাল থেকে বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠে বসুন্ধরা ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ২০২৪-২৫ মৌসুমের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব বনাম শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের ম্যাচ ছিল। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে মাঠে ছিলেন তামিম ইকবাল। খেলা শুরুর কিছুক্ষণ আগে তামিম হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন। প্রথমে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট তাকে অ্যাটেন্ড করেন এবং গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডিটি ভেবে কিছু ওষুধ খেতে দেন। একই সাথে বিকেএসপির একজন স্পোর্টস মেডিসিন স্পেশালিস্ট চিকিৎসককে জরুরি তলব করা হয়। তিনি দ্রুতই আসেন। তামিম তাকে জানান যে ব্যথাটা বুক থেকে চোয়ালের দিকে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে হালকা কমছে। তামিমও মনে করছেন এটি অ্যাসিডিটির ব্যথা। কিন্তু অ্যাসিডিটির ওষুধ খাওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি পেলেও প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর ব্যথা আবারও তীব্র হয়ে ওঠে। তখন দ্রুত তাকে বিকেএসপির অনতিদূরে অবস্থিত ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজে’ নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ইমারজেন্সিতে ইসিজি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় টেস্ট (যেমন রক্তের ট্রপোনিন-আই) করানো হয়। ইসিজি রিপোর্টে শুধু ব্রাডিকার্ডিয়া (হার্ট বিট কমে যাওয়া) ধরা পড়ে। কিন্তুট্রপোনিন-আই অনেক বেশি আসে, যা হার্ট অ্যাটাক হওয়াকে নিশ্চিত করে। রোগীকে ভিভিআইপি কেবিনে শিফট করা হয়।
হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট ডা. মনিরুজ্জামান মারুফ শুরু থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তিনি হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা অবিলম্বে শুরু করতে তৎপরতা শুরু করেন। কিন্তুরোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার
একটি নামজাদা বহুজাতিক কর্পোরেট হাসপাতালে চলে যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার পক্ষ থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স (হেলিকপ্টার) ডাকা হয়। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হাসাপাতালের মেডিকেল ডিরেক্টর ডা. রাজীব হাসান, কার্ডিওলজিস্ট ডা. মারুফ প্রমুখের সনির্বন্ধ অনুরোধ অগ্রাহ্য করে তিনি উপর থেকে নিচে নেমে সড়ক পথের অ্যাম্বুলেন্সে গিয়ে বসে পড়েন। হাসাপাতালের একজন ইমার্জেন্সি চিকিৎসক ও নার্স সাথে দিয়ে দেয়া হয়। হেলিকপ্টার বিকেএসপির অ্যাথলেটিক্স গ্রাউন্ডে অবস্থান করছিল। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স বিকেএসপিতে ঢোকার পরমুহূর্তেই রোগীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যায় এবং তিনি পুরো শরীরটি ছেড়ে দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। পাল্স, ব্লাড প্রেশার কোনটাই পাওয়া যাচ্ছিল না। সাথে থাকা ফজিলাতুন্নেছা হাসাপাতালের চিকিৎসক সেই মুহূর্তেই তাকে ইমারজেন্সি কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর CPR) প্রদান শুরু করেন। তখন আর হেলিকপ্টারে ওঠানোর সময় বা সুযোগ কোনটাই ছিল না। দ্রুতগতিতে তাকে ফজিলাতুন্নেছা হাসাপাতালে ফেরত আনা হয়। পথিমধ্যে সিপিআর দেয়া অব্যাহত থাকে। হাসপাতালে পৌঁছানোর পরপরই ইমারজেন্সিতে কোড ব্লু কল করা হয়। কার্ডিওলজিস্ট ডা. মারুফের নেতৃত্বে অ্যানেসথেশিওলজিষ্ট ডা. মনিরুজ্জামান, ডা. রাসেল আরাফাত, ডা. রঞ্জন কুমার মণ্ডল, ইন্টার্নাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অমল কৃষ্ণ পাল, ডা. আদনান বুলবুলসহ একদল নিবেদিতপ্রাণ ও দক্ষ চিকিৎসক রোগীর জীবন বাঁচাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রোগীকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়, ইনটিউবেট (কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য শ্বাসনালীর ভিতর নল ঢোকানো) করা হয়। ২২ মিনিট সিপিআর ও ৩ বার শক (DC shock) দেওয়া পর ক্যারোটিড পাল্স (ঘাড়ের রক্তনালীর স্পন্দন) পাওয়া যায়। সাথে সাথে ক্যাথ ল্যাবে নিয়ে অ্যাঞ্জিওগ্রাম (angiogram) করা হয়। এরপর প্রাথমিক পিসিআই (Primary PCI) করে ১০০% বন্ধ রক্তনালী খুলে দেওয়া সম্ভব হয়। তার লাইফ সাপোর্ট প্রত্যাহার করা হয়। পরদিন রোগী সুস্থ দেহে ঐ হাসপাতাল ছেড়ে যান।
উপরোক্ত মেডিকেল পদ্ধতিসমূহ সম্পর্কে সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করি। CPR-এ বুকের কেন্দ্রে দুই হাত উপর্যুপরি রেখে প্রায় ২ ইঞ্চি গভীরে জোরে এবং দ্রুত ধাক্কা/চাপ (compression) দেয়া হয়, প্রতি মিনিটে ১০০ থেকে ১২০টি হারে; একই সাথে মুখে মুখ লাগিয়ে বা আম্বু ব্যাগের (Ambu Bag) সাহায্যে উদ্ধার শ্বাস (rescue breath) দেয়া হয়, প্রতি ৩০টি বুকের ধাক্কার জন্য ২বার, যদিও কিছু ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বুকে ধাক্কা দেয়া যথেষ্ট হতে পারে। এটি মস্তিষ্ক এবং হৃদপিণ্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিতে রক্ত প্রবাহ বজায় রাখতে সাহায্য করে। DC shock (ডাইরেক্ট কারেন্ট শক) ডিফিব্রিলেশন নামেও পরিচিত; এতে একটি ডিফিব্রিলেটর যন্ত্রব্যবহার করা হয় হার্টে নিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিক শক প্রদানের জন্য, যা অস্বাভাবিক হার্ট বিট বন্ধ করে এবং হার্টকে স্বাভাবিক ছন্দে পুনরায় সেট করতে দেয়। অ্যাঞ্জিওগ্রাম (বা অ্যাঞ্জিওগ্রাফি)-এ সাধারণত কুঁচকি বা কব্জির একটি ধমনিতে একটি ক্যাথেটার (পাতলা নল) ঢোকানো হয়; এই ক্যাথেটারের মাধ্যমে একটি বিশেষ রঞ্জক (কনট্রাস্ট রঞ্জক) হার্টের রক্তনালীতে প্রবেশ করানো হয়। এই রঞ্জকটি এক্স-রে ছবিতে রক্তনালীগুলিকে দৃশ্যমান করে তোলে, যার ফলে ডাক্তাররা দেখতে পান ধমনিতে কোন ব্লক বা সংকীর্ণতা আছে কিনা। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি (angioplasty) হল একটি পদ্ধতি যা সাধারণত হার্টের ব্লক বা সংকীর্ণ ধমনি খোলার জন্য ব্যবহৃত হয়; এতে একটি ছোট বেলুন একটি ক্যাথেটারের ডগায় সংযুক্ত করা হয়, যা পরে ব্লক হওয়া ধমনিতে ঢোকানো হয়। ধমনি প্রশস্ত করার জন্য বেলুনটি ফুলিয়ে দেওয়া হয়, যা রক্তপ্রবাহ উন্নত করে। প্রয়োজন হলে বেলুনটি সরানোর পরে ধমনিটি খোলা রাখার জন্য স্টেন্ট (stent) নামক একটি ছোট জাল নলও (mesh tube) স্থাপন করা হয়, যার ভিতর দিয়ে রক্ত স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে। সাধারণ মানুষ ভুল করে একে রিং বলে থাকে, আসলে এটি স্টেন্ট। প্রাথমিক পিসিআই (পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন) হল একটি নির্দিষ্ট ধরণের অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি যা জরুরি অবস্থার সময় করা হয়, সাধারণত যখন একজন রোগীর মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন চলমান থাকে তখন ব্লকড ধমনী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খোলার জন্য করা হয়। প্রাথমিক পিসিআই যত দ্রুত করা হবে (লক্ষ্য ৯০ মিনিটের মধ্যে), ফলাফল
তত ভালো হবেÑ হাসপাতালে এটিকে ‘ডোর-টু-বেলুন টাইম’ (door-to-ballon time) বলে। অন্যদিকে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হল সিডিউলড কাজ (জরুরি নয়), ব্লকেজকে স্থিতিশীল (stable) করার জন্য করা হয়।
Nothing succeeds than success সাফল্যের চেয়ে সফল আর কিছুই হতে পারে না। তামিমের বেলায় সাফল্য পাওয়া গেলেও মান্নার বেলায় পাওয়া যায়নি। কেন? পার্থক্যটা খেয়াল করুন। ১৯৯৭-২০০৮ সময়কালে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা চিত্রনায়ক মান্নার কথা বলছি। ২০০৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি মান্না বুকে ব্যাথা নিয়ে গুলশানের একটি অভিজাত হাসপাতালে গেলেন। ইমার্জেন্সিতেই রোগ ডায়াগনসিস হলো হার্ট অ্যাটাক (AMI)। চিকিৎসকবৃন্দ জরুরি চিকিৎসা দিয়ে ভর্তির অ্যাডভাইস করলেন, সম্ভাব ঝুঁকির কথাও শোনালেন। কিন্তু না, তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলেন না, কারণ তার বুকব ব্যাথা কমে গেছে। উপরন্তু তিনি নিজেই ড্রাইভ করে বাসায় ফিরে গেলেন! বিধি বাম! বাসায় ফিরে আবার তীব্র ব্যাথা (Massive AMI) এবং বাসায়ই তিনি লুটিয়ে পড়েন এবং বস্তুত তিনি তখনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন! অতঃপর তাকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হয়, ‘ব্রট ডেড’ ! তখন আর চিকিৎসকদের করার কিছুই ছিল না, ডেথ ডেকলারেশন করা ছাড়া। কিন্তু অভিযোগ করা হল ভুল চিকিৎসা করা হয়েছে, চিকিৎসায় অবহেলা করা হয়েছে ইত্যাদি। হাসপাতাল ভাংচুর হলো, চিকিৎসকদের নামে মামলা হলো, তাদেরকে আদালতে নেয়া হল, মিডিয়ায় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে নির্বিচার সমালোচনা করা হলো। তামিমের ঘটনাও একই ধরণের মর্মান্তিক পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হাসাপাতালে প্রথমবার যখন তিনি এলেন এবং তার রক্তের ট্রপোনিন-আই মাত্রাতিরিক্ত পাওয়া গেল, তখন তিনিও চিকিৎসকদের পরামর্শ শোনেননি, ওখানে ভর্তি থাকেননি। এসব ক্ষেত্রে সময় মহামূল্যবান। তিনি যদি ঐ হেলিকপ্টারে উঠে বসতেন তাহলে ঐ সময় তিনি হারাতেন, আসলে সময়টা চিকিৎসকরা হারাতেন, যা তাদের চিকিৎসাকার্যের জন্য অপরিহার্য ছিল। ফলে পরিণতি কী হতে পারত তা সহজেই অনুমেয়।
এখন আসুন যে প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়েছে, নিয়মিত শরীরচর্চার ভিতর থাকা সত্ত্বেও তামিমের মত তরতাজা যুবক কেন হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলো সে প্রসঙ্গে। মান্নাও তো কঠোর কায়িক পরিশ্রমের মধ্যে ছিলেন, তারই বা অমন কেন হল! সেজন্য জানতে হবে হার্ট অ্যাটাক কেন হয়? উত্তর এখনও অজানা। সংক্রামক ব্যাধি (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি জীবাণুঘটিত) ব্যতীত অধিকাংশ রোগেরই কারণ বিজ্ঞানীরা আজও উদ্ধার করতে পারেননি। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টরসমূহ (Risk Factors) চিহ্নিত করা গেছে, যেগুলো হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। ঝুঁকি ২ প্রকার আচরণজনিত এবং জৈবিক।
১. আচরণজনিত (behavioral) প্রধান প্রধান ঝুঁকি হচ্ছে:
ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার
অতিমাত্রায় মদ্যপান
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (ফল এবং সবজি কম খাওয়া, লবণযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া) এবং রা. অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম
২. জৈবিক (biological) প্রধান প্রধান ঝুঁকি হচ্ছে:
অতিরিক্ত ওজন (overweight) এবং স্থূলতা (obesity)
উচ্চ রক্তচাপ (high blood pressure)
রক্তে গ্লুকোজের উচ্চমাত্রা এবং
রক্তের অস্বাভাবিক লিপিড/ফ্যাট (কোলেস্টেরল বৃদ্ধি সহ)
এগুলো শুধু হার্ট অ্যাটাকের নয়, বরং প্রধান প্রধান ‘অসংক্রামক রোগ’ (Noncummunicable Disease=NCD), যেমন: কার্ডিওভাসকুলার রোগ (উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ইত্যাদি), ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ (COPD), ডায়াবেটিসেরও ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর। এমনকি শুধু এনসিডির ক্ষেত্রে নয়, জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নাল দ্য ল্যান্সেট (The Lancet)-এ ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ (GBD) অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী রোগের জন্য অবদান রাখে এমন শীর্ষ ১০টি ঝুঁকি র্যাংকিং করা হয়; এর মধ্যে ১ম স্থানে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, ২য় স্থানে ধূমপান, ৩য় ও ৫ম স্থানে যথাক্রমে রক্তে গ্লুকোজের উচ্চমাত্রা ও উচ্চ বডি-মাস ইনডেক্স (উচ্চতা অনুয়ায়ী আদর্শ ওজন নির্দেশক BMI)। তাছাড়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য মোতাবেক, বিশ্বব্যাপী আকস্মিক মৃত্যুর শীর্ষ কারণেসমূহের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে হার্ট অ্যাটাক তথা ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ (IHD), ২য় ও ৩য় স্থানে যথাক্রমে স্ট্রোক ও শ্বাসতন্ত্রের অসাড়তা।
এখন উপর্যুক্ত ৮টি ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর লক্ষ্য করুন। তামিম ইকবাল ও মান্নার ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম এবং অতিরিক্ত ওজন/স্থূলতা যে প্রযোজ্য নয়, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বাকি ৬টি ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টরের অবস্থা সম্বন্ধে কিন্তু সাধারণ মানুষ অবগত নয়। সেগুলো সম্বন্ধে সেবপ্রদানকারী চিকিৎসকরাই ভালো জানেন, কিন্তু রোগীর গোপনীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে এখানে আলোচনা করার সুযোগ নেই। কিন্তু এমন সরল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া মারাত্মক ভুল হবে যে, পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ করে কোন লাভ নেই। সবগুলা ঝুঁকি একই সাথে বর্তমান থাকা আবশ্যক নয়, বরং একটি মাত্র ঝুঁকিই মৃত্যুর (এমনকি আকস্মিক মৃত্যুর) কারণ হতে পারে। (এ লেখাটা যখন লিখছি, দুঃখজনক ও নিন্দনীয় যে, তখন মেডিকেল এথিক্সের কোড অব কন্ডাক্ট লঙ্ঘন করে বহুজাতিক কর্পোরেট হাসপাতালের একজন চিকিৎসক তামিম ইকবালের আচরণজনিত কী কী ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর আছে তা ঘটা করে জনসমক্ষে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন)। ভালোভাবে জানা প্রয়োজন যে, আচরণগত ঝুঁকিগুলি এমন কর্ম বা অভ্যাস যা ব্যক্তি জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে পারে, এজন্য এগুলোকে ‘পরিবর্তনযোগ্য’ (modifiable) ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধূমপান ত্যাগ করা, নিয়মিত হাঁটা/ব্যায়াম করা, সুষম খাদ্য গ্রহণ করা এবং অ্যালকোহল গ্রহণ পরিত্যাগ/কমানোর মাধ্যমে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। অপরদিকে, জৈবিক ঝুঁকিগুলি একজন ব্যক্তির জৈবিক গঠনের সাথে সম্পর্কিত অভ্যন্তরীণ বিষয়, যার মধ্যে কিছু চিকিৎসার মাধ্যমে পরিবর্তন করা যেতে পারে, অন্যগুলিও কিছুটা পরিবর্তনযোগ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস (টাইপ ২) ওষুধ, খাদ্য এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। স্থূলতা ও উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা খাদ্য, ব্যায়াম এবং ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। আরো কিছু জৈবিক ফ্যাক্টর, যেমন জেনেটিক্স, বয়স এবং লিঙ্গ পরিবর্তনযোগ্য নয়, যেগুলো এনসিডি হওয়ার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে যদিও জেনেটিক গঠন পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তুজেনেটিক কাউন্সেলিং এবং প্রাথমিক স্ক্রিনিং জেনেটিক ফ্যাক্টরগুলির সাথে সম্পর্কিত ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারে।
২০১৮ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম)-এর পক্ষে আমি প্রধান গবেষক হিসেবে বাংলাদেশে ‘অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিসমূহের জাতীয় জরিপ’ (STEPS Survey) পরিচালনা করেছিলাম। STEPS Survey হচ্ছে একটি দেশে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকির ব্যাপ্তি পর্যবেক্ষণের জন্য WHO কর্তৃক প্রণীত একটি আদর্শপদ্ধতি যা ০৩ (তিন) টি ধাপে সম্পন্ন করা হয়। জরিপের মূল সন্দর্ভটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নাল BMJ Open-এ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রাপ্তবয়স্ক (১৮-৬৯ বছর) মানুষের কাছ থেকে ডেটা (উধঃধ) ও নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। ফলাফলে পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশের বেশীরভাগ (৭০.৯%) মানুষ ১টি বা ২টি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ৩টি বা ৪টি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সদর দপ্তরের উদ্যোগে ২০০০- ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সহ ১৬৩টি দেশ ও এলাকা (Territory)-য় সম্পাদিত ৫০৭টি জনসংখ্যা ভিত্তিক জরিপ থেকে ৫৭ লক্ষ মানুষের ডেটা ব্যবহার করে 'প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী) মানুষের ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রবণতা' শীর্ষক গবেষণা করা হয় এবং গবেষণাপত্রটি ঞযব খধহপবঃ-এ প্রকাশিত হয়। ফলাফল বলছে ২০২২ সালে বিশ্বে অপর্যাপ্ত পরিশ্রমকারী মানুষের হার হচ্ছে ৩১.৩%, যা ২০০০ সালের তুলনায় বেশি (তখন ছিল ২৩.৪%) এবং ২০১০ সালের তুলনাতেও বেশি (তখন ছিল ২৬.৪%)। ১৯৭টি দেশ ও এলাকার মধ্যে ১০৩ টিতে (৫২%) এবং ৯টি অঞ্চলের মধ্যে ৯টিতে (৬৭%) এই হার বেশি। পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে অপর্যাপ্ত পরিশ্রমকারীর হার ৫ শতাংশ পয়েন্ট বেশি (নারী ৩৩.৮%, পুরুষ ২৮.৭%)। এভাবে চলতে থাকলে ২০১০ সালের তুলনায় বিশ্বে অপর্যাপ্ত পরিশ্রমকারী মানুষের হার ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫% কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না। তবে দুটো অঞ্চল, ওশেনিয়া এবং সাব-সাহারান আফ্রিকা, এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সঠিক পথে এগুচ্ছে। ঐ গবেষণায় বাংলাদেশের STEPS-এর ডেটা ব্যবহার করা হয়, যাতে অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমকারীদের শতকরা হার পাওয়া গিয়েছিল ২৯.১% (পুরুষ ৩৪.১%, নারী ২৪.৩%)। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ২৯ ভাগের বেশি মানুষ অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করে থাকে। WHO-র গবেষণায় বলা হয়েছে- অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম অসংক্রামক রোগ, শারীরিক ও কগনিটিভ অক্ষমতা, স্থূলতা এবং মানসিক ভগ্নস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। কগনিটিভ কাজের উদাহরণ হচ্ছে শেখা, চিন্তা করা, স্মরণ রাখা, সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি। এতো গেল শারীরিক পরিশ্রম সংক্রান্ত।
তামাক সেবনের পরিসংখ্যান একটু দেখে নেই। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (GATS) বাংলাদেশ ২০১৭ অনুসারে, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তামাক ধূমপানকারী ১৮.০%, যা প্রায় ১ কোটি ৯২ লক্ষ জনসংখ্যা। বর্তমানে (current) তামাক ধূমপায়ী পুরুষ ৩৬.২% এবং মহিলা ০.৮%। তামাক ধূমপায়ীদের মধ্যে পণ্য ব্যবহারের বণ্টন: তৈরি সিগারেট ৭৭.১%, বিড়ি ২৯.০%, হুক্কা: ০.৫% ইত্যাদি। এগুলো শুধুই ধোঁয়া উৎপাদনকারী (smoking) তামাকসেবীদের হিসাব। এর বাইরে রয়েছেন ধোঁয়াবিহীন (smokeless) তামাকসেবীরা। ধোঁয়াবিহীন তামাকের মধ্যে রয়েছে চিবানো তামাক (জর্দা, গুল, সাদাপাতা), নস্যি (snuff), পান ও তামাক দিয়ে তৈরি পানীয় (betel quid) ইত্যাদি। ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকারীর হার ২০.৬% অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি ২০ লক্ষ। সুতরাং, বাংলাদেশের ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে ধূমপায়ীদের চেয়ে ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকারীর সংখ্যা বেশি। বিশ্বব্যাপী ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি, যা মুখের ক্যান্সারের মহামারীতে অবদান রাখছে (প্রতি বছর ৩০,০০০+ নতুন রোগী)।
তুলনামূলকভাবে অপরিচিত একটি হাসপাতালে তামিম ইকবালের মত ক্রিকেটারের চিকিৎসা হয়েছে বলে বিভিন্ন ধরণের তির্যক মন্তব্যও লক্ষ্য করা গেছে। হাসপাতালটি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমেরারিয়াল ট্রাস্ট’ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, নাম ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতাল ও নাসির্ং কলেজ’। বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের কার্যালয় ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে। ‘বঙ্গবন্ধু জাদুঘর’ পরিচালনা করা ছাড়াও বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্ন ধরণের জনসেবামূলক কাজ করছে।
এটি মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহিদ, আহত, নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে; দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিক্ষাবৃত্তি এবং অন্যান্য সাহায্য প্রদান করে থাকে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিনামূল্যে হেল্থ ক্যাম্প করে থাকে। বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের গঠনতন্ত্রে শহিদ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে একটি হাসপাতাল, মাতৃসদন এবং শিশু চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অনেক আগে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী ফাউন্ডেশন’-এর নামে গাজীপুর সদরের কাশিমপুর ইউনিয়নের সারাবো মৌজায় ৬.১৩ একর জমি ক্রয় করেছিলেন। ঐ জমি বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের নামে হস্তান্তর করে সেখানে ২৫০ শয্যার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হাসপাতাল ও ৫০ আসনের নার্সিং কলেজ নির্মিত হয়। ১৮ই নভেম্বর ২০১৩ তারিখে একটি আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের সহ-সভাপতি শেখ রেহানা যৌথভাবে এটি উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের সাথে চুক্তি মোতাবেক মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান Kumpulan Perbatan (Johor) Sdn Bhd (KPJ) ‘অপারেশন পার্টনার' হিসেবে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি ইমার্জেন্সি, আউটডোর, ইনডোর সব বিভাগেই সুলভে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকে। নার্সিং কলেজ থেকে উত্তীর্ণ নার্সরা দেশ-বিদেশে সুনামের সাথে কাজ করছে।
তামিমকে জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসাসেবা দেয়ার পরেও চিকিৎসকদের নিস্তার নেই। মন্তব্য এসেছে, ‘তামিম বলে এই চিকিৎসা পেয়েছে...সাধারণ মানুষ হলে মরে ভুত হয়ে যেত!’ কিংবা ‘এরকম একটা দুইটা ঘটনার সফলতা দিয়ে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল্যায়ন করা যায় না!’ অথচ হার্ট এ্যাটাকের সর্বাধুনিক এই Primary PCI চিকিৎসা এখন শের-ই-বাংলা নগরস্থ ‘জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল’ (NICVD) সহ বাংলাদেশের অনেক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত হচ্ছে এবং অনেক সাধারণ রোগী প্রতিদিন এর সুফল পাচ্ছেন। আবার বলা হচ্ছে, ‘বাঁচছে তো কি হইছে! চিকিৎসকের বাঁচানোর ক্ষমতা নাই...বাঁচানোর মালিক কেবলমাত্র আল্লাহ।’ একদম ঠিক কথা। কিন্তু তাহলে রোগী মারা গেলে হাসাপাতাল ভাংচুর কেন! চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলা কেন! রোগীর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চিকিৎসকদের অনেক দুঃসাহসী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সেজন্য তার নিজের দরকার দৃঢ় মনোবল, রোগীর পক্ষ থেকে দরকার চিকিৎসকের প্রতি আস্থা। কিন্তু এ ধরণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া চিকিৎসকদের মনোবলের ভিত কাঁপিয়ে দেয়, চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কে আস্থার জায়গায় প্রবল আঘাত করে। পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ক্ষেত্রে সতর্কথাকা সকল পক্ষের জন্য বাঞ্ছনীয়।
শেষ কথা হচ্ছে- অসংক্রামক রোগের আচরণজনিত ঝুঁকিসমূহ জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে এগুলো পরিবর্তনযোগ্য অর্থাৎ আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্ত রোগ তথা এসব রোগপ্রসূত মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। কাজেই কর্মক্ষেত্রে, বাড়িতে, যাতায়াতে ও অবসর সময়ে শারীরিক পরিশ্রম করতে আমাদের পরিকল্পনা থাকতে হবে, ব্যবস্থা থাকতে হবে, উদ্যোগীও হতে হবে। বিশ্ববিশ্রুত রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি প্রচুর মদ্যপান করতেন, একবার গুরুতর অসুস্থ হলেন। এক ভক্ত তাঁকে চিঠি লিখেলেন, ‘আপনার স্বাস্থ্য জাতীয় সম্পদ, আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে আপনি জাতীয় সম্পদের অনিষ্ট করতে পারেন না।’ প্রকৃতপক্ষে, কেবল ব্যক্তিবিশেষের স্বাস্থ্য নয়, প্রত্যেকের স্বাস্থ্যই প্রত্যেকের সম্পদ তথা দেশের সম্পদ, না হলে আমরা ‘মানবসম্পদ’ বলি কেন। ফেলে রাখলে হবে না, এর যত্ন নিতে হবে। অতএব ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ থেকে দূরে থাকুন, শারীরিক পরিশ্রম করুন, নিদেনপক্ষে হাঁটুন, সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন।
'শরীর মরে গেলে তুইও মরে যাবি রে কবি,
এত সুর, এত প্রাণ সবই হারাবি,
আপন শরীরের দিকে আর কবে তাকাবি!'
- জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ, গীতিকার এবং প্রবন্ধকার