Logo
Logo
×

মতামত

'বাংলাদেশ জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্য'

Icon

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৮ পিএম

'বাংলাদেশ জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্য'

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের অর্থনীতি একদিকে সম্ভাবনাময়, অন্যদিকে নানা সংকটে জর্জরিত। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজও “জাতীয় সম্পদের বিকাশ” এবং “জাতীয় সম্পদ লুন্ঠন”—এই দুই বিপরীত প্রবণতা আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় পাশাপাশি অবস্থান করছে। যেখানে একদিকে উদ্যোক্তা, কৃষক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগীরা উৎপাদনমুখী অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী করতে চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে দুর্নীতি, অর্থপাচার, ব্যাংক লুট, অদক্ষ নীতি ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় সম্পদের অপচয় ঘটছে। এই দ্বৈত প্রবণতার সমাধানই আজ বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

ব্রিটিশ শাসন ভারতের হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতিকে বিভক্ত করে দেয়। যখন ব্রিটিশরা ভারতে আসে, তখন মোগল সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের ধনীতম সাম্রাজ্য,

আর বাংলা ছিল তার সমৃদ্ধতম প্রদেশ। ব্রিটিশরা বাংলাকে শোষণ ও লুট করে এমন দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়, যেখানে দুর্ভিক্ষ নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে ওঠে — যা আগে কখনো ছিল না। তাদের “divide and rule” নীতির কারণে মুসলমানরা ক্ষমতা, সম্পদ, চাকরি, ব্যবসা, শিক্ষা—সব ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হয়,

অন্যদিকে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ প্রশাসনের দ্বিতীয় স্তরের শাসক।

১৯১৬ সালের লখনৌ চুক্তির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হয়েছিল, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন সারোজিনী নাইডুর ভাষায় “হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত” হিসেবে প্রশংসিত হন।

কিন্তু কংগ্রেস যখন এই চুক্তি ভঙ্গ করে, তখন থেকেই ভারতের বিভাজন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৮৭১ সালে ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টার মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে লেখেন— "১৭০ বছর আগে বাংলার কোনো অভিজাত মুসলমানের দারিদ্র্যসীমায় পতন অসম্ভব ছিল; কিন্তু এখন কোনো মুসলমানের পক্ষে সম্পদশালী থাকা প্রায় অসম্ভব।” এই বৈষম্য সারাদেশেই একইরকম ছিল।

তাই পাকিস্তানের দাবি ছিল মূলত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম।

এইভাবেই “দ্বিজাতি তত্ত্ব” (Two-Nation Theory) ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যৌক্তিক হয়ে ওঠে। ফলে পাকিস্তানের সৃষ্টি ছিল ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা, যেমন পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্মও একটি ঐতিহাসিক অনিবার্যতা। তবে এই আন্দোলনের বড় দুর্বলতা ছিল — অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি। মুসলিম লীগ ধনীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল; তারা স্বাধীনতার পরেও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছিল। ফলে পাকিস্তানে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে একদল ধনী অলিগার্কি গড়ে ওঠে, যা জাতীয় রাজনীতির প্রধান সংকট হয়ে দাঁড়ায়।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৫৪ বছরেও কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের  মুক্তি হয়নি,  মুক্তি হয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের। এদেশে গত ৫৪  বছর হলো ৫% লোক,  ৯৫%লোকের অর্থ শোষণ করছে। এদের নিকট দেশ জিম্মি হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি মানুষের রক্তকণিকার শিরা-উপশিরায় এমনভাবে  ছড়িয়ে পড়েছে পক্ষাঘাত ক্যান্সারের মত। দেশে একটি লুটপাটকারী অলিগার্কি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অলিগার্কদের পতন হওয়া  উচিত। 

"পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল, আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন।

 গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি রিপোর্টস (জিএফআইআরএস) এর তথ্য মতে।  অর্থ পাচার বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৪ শতাংশের পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ও প্রবাস আয় থেকে যত অর্থ এসেছে, এর এক-পঞ্চমাংশ পরিমাণ অর্থ এক বছরে পাচার হয়। বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ হিসেবে যত অর্থ আসে, এর দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। অর্থ পাচারের বিষয়টিকে অর্থনীতিতে ক্ষতিকর ‘টিউমার’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির ৩৯৭ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে সব মিলিয়ে ২২টি ক্ষেত্রে আলোকপাত করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, সরকারি ব্যয় (সরকারি বিনিয়োগ, এডিপি, ভর্তুকি ও ঋণ), ঘাটতি বাজেট অর্থায়ন, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা, সরকারি কেনাকাটা ও খাদ্য বিতরণ, রপ্তানি, আমদানি, প্রবাসী আয়, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি অর্থায়ন। এই টাকা পাচারের জন্য দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের ক্রীড়নক, আমলাদের মধ্যে একধরনের অনৈতিক চক্র গড়ে ওঠে। ঘুষ-দুর্নীতি, আর্থিক অপরাধ, মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে বাণিজ্য, ব্যাংক থেকে চুরি করা টাকা, খেলাপি ঋণের অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেখানো, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, কর ফাঁকি—এসব কর্মকাণ্ডের অর্থ পাচার করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ করের অভয়ারণ্য নামে পরিচিত ছোট ছোট দেশে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে। মূলত বাড়ি কিনে এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করে টাকা পাচার করা হয়।

দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ৫৩২টি বাড়ি আছে, যার মূল্য সাড়ে ৩৭ কোটি ডলার। ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০০ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে মনোনীত হয়েছেন। ২০২৩ সালে ইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৮১৫ কোটি ডলার পাচার হয়। এই সব টাকা পাচার করা হয়েছে  রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা; প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি; আইনি দায়মুক্তি এবং সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের অভাবে। 

এ দেশে ঘুষ-দুর্নীতিসহ অন্যান্য অনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়েছে। কিন্তু অর্থ পরিশোধ হয়েছে বিদেশে। আগে ঘুষ-দুর্নীতির অর্থ দেশেই বিনিয়োগ হতো, একটি ছায়া অর্থনীতি সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেশে টাকা রাখার পরিবর্তে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ নিরাপদ রাখার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে নানা ধরনের সম্পদ কেনা হয়। যারা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে তারা জাতির শত্রু। সরকারি বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন পণ্য ও সেবা কেনা হয়েছে, তাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ সড়ক, সেতু, বিদ্যুৎ অবকাঠামো, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ইত্যাদি খাতে ব্যয় হয়েছে। এ থেকে ঘুষ হিসেবেই দিতে হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ ঘুষ নিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাঁদের সহযোগীরা। রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় গত ১৫ বছরে লুটপাটকারীরা ব্যাংক দখল করে নিয়েছে। দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যা দিয়ে ১৩টি মেট্রোরেল বা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। এরপর বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে, অথচ অন্তর্বর্তী সরকার এই ব্যাংক লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, যা জাতির জন্য হতাশাব্যাঞ্জক। 

পতিত আওয়ামী লীগ   সরকারের আমলে প্রতারণা,  কারসাজি, প্লেসমেন্ট শেয়ার ও আইপিওতে জালিয়াতির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রভাবশালী উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক ও বিনিয়োগকারীদের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মাধ্যমে কারসাজির একটি বড় নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। বাজারের মধ্যস্থতাকারীরা দেউলিয়া হয়েছে, তাদের ইক্যুইটি ৩০ হাজার কোটি টাকা নেতিবাচক। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে  ফ্যাসিবাদী  আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের খরচের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত টাকা লুটপাট করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাড়তি খরচ দেখিয়ে এই বিপুল অর্থ লুটপাট করেছেন বিদায়ী ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও সুবিধাভোগীরা। সরকারের নিজস্ব তহবিলে জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় গঠন করা বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্টের ৮৯১ প্রকল্পে ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ১১০ কোটি টাকা দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বিসিসিটি প্রকল্পের ৫৪ শতাংশের বেশি অর্থ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। দুর্নীতির দুষ্টচক্র সব স্তরে ঘিরে বসেছে। 

২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৬.১ শতাংশ, এবং মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় প্রায় ২,৭৬৫ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো - BBS)। কিন্তু এই উন্নয়নের পেছনে রয়েছে জাতীয় সম্পদের বিকাশ। বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদের বিকাশ মূলত তিনটি উৎস থেকে এসেছে— দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ, প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স), রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধি (বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প)।২০২৪  সালে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় ছিল প্রায় ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তৈরি পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪%। কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME), এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায় যে জাতীয় সম্পদ সৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত অর্থনীতি গড়ে উঠছে।

জাতীয় সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন ও সংকট কিন্তু এই বিকাশের পাশাপাশি বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে জাতীয় সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের মহামারি আকার ধারণ করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের সর্বশেষ  তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনা দেখা যায়, গত বছরের জুনে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ বিতরণের স্থিতি ছিল প্রায় ১৫ লাখ ৯৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ  ছিল ১ লাখ ৯৪ হাজার কোটি  ৮৪৬ টাকা যা, মোট ঋণের ১২ দশমিক ১২ শতাংশ। গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ বিতরণের স্থিতি বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৭ লাখ ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৩৩ কোটি টাকা। এটি ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ৪ লাখ ২১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ ছিল। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপিঋণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৮ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বাংলাদেশ জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের একটি স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে এবং  যা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও তা ধারাবাহিকভাবে চলমান আছে। বর্তমানে এস আলম গ্রুপের মত ব্যাংক লুটপাটকারীরা দেশে নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের  প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে,  অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চলমান সময়েও জাতীয় সম্পদ লুটের মহাউৎসব চলছে। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে জাতির অনেক চাওয়া ছিল, প্রত্যাশা ছিল জাতির সর্বজনীন কল্যাণে কাজ করবেন।  ব্যাংক লুটপাটকারি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে এনে কৃষক ও ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদেরকে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ করার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু  অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ব্যাংক লুটপাটকারি ও  দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।  ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি সর্বজনীন কল্যাণে অনেক কাজ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস সর্বজনীন কল্যাণে কাজ করার চেয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া দেশে উন্নয়ন ও অর্থনীতির বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ সবার অংশগ্রহণমূলক সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে  গণতান্ত্রিক সরকার। 

সরকারি প্রকল্পের ব্যয়ের অস্বচ্ছতা ও অতিরিক্ত খরচের কারণে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে এবং বাজেটের ২৫–৩০% পর্যন্ত অপচয় হচ্ছে। এই অবাধ লুণ্ঠন রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করছে, বিনিয়োগ পরিবেশে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে এবং জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়ছে। এই অবাধ দূর্নীতির কারণে গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো একেবারেই প্রায় ওকেজো হয়ে পড়েছে। দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য থেকে এক কার্যকারণ সূত্র ধরে কিছু কথা প্রকাশ করলাম। ভিশনটি নিয়ে  কার্যকারণ সূত্র ধরে আরো অনেক একান্ত প্রয়োজনীয় কথা জানা সম্ভব হবে। কাজের জন্য সেই দিকটিতে মনোযোগ দেওয়া, তথ্য সংগ্রহ করা এবং  কার্যকারণের কর্মসূচি দেখে কাজের ধারায় অগ্রসর হতে হবে।  

জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের কারণঃ দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কাঠামো ও রাজনৈতিক প্রভাব। অবৈধ সম্পদ পাচারে আন্তর্জাতিক সংযোগ। অর্থনৈতিক খাতে দায়মুক্তি সংস্কৃতি। দুর্বল আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতার অভাব। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর রাজনৈতিক দখলদারি।

সংকট থেকে উত্তরণের উপায়:

* আইনের শাসন, অর্থনৈতিক অধিকার ও সংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।  প্রত্যেক রাজনৈতিক দলগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। রাজনৈতিক দল দুর্নীতিমুক্ত হলে রাজনীতিবিদ দুর্নীতিমুক্ত হবে।   রাজনৈতিক দল হচ্ছে রাষ্ট্র গঠনে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। কোনো সংসদীয় এলাকায় সংসদ সদস্য দুর্নীতিমুক্ত হলে, আমলা ও ব্যবসায়িরা দুর্নীতি করতে পারবে না। রাষ্ট্র সংস্কারের চেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের ও নেতৃত্বের সংস্কার। 

* দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।  দুর্নীতিবিরোধী কমিশনকে (দুদক) রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। বড় অর্থনৈতিক অপরাধে জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর করতে হবে।

* অর্থ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।  ব্যাংকিং খাতে অর্থপাচার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (Financial Action Task force) অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি জোরদার করতে হবে।

* স্বচ্ছ বাজেট ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সকল উন্নয়ন প্রকল্পে ই-টেন্ডারিং ও ডিজিটাল মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জনঅংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। 

* দেশীয় উদ্যোক্তাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে সহজ ঋণ ও কর সুবিধা দিতে হবে। প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও স্টার্টআপ ফান্ডিং বাড়াতে হবে।

* রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।  রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়নের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। 

* শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষা ও উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। দক্ষ জনশক্তিকে দেশেই বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।

* জাতীয় সম্পদের বিকাশে তরুণ সমাজকে উদ্যোগী করতে রাষ্ট্রের  সুপরিকল্পনা করতে হবে  এবং  সহজ শর্তে ঋণ  প্রদান করতে হবে।

জাতীয় সম্পদের বিকাশ বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু এই সম্পদের লুণ্ঠন ও অপচয় যদি অব্যাহত থাকে, তবে উন্নয়নের ভিত্তিই একেবারেই ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। দুর্নীতি একবারে বন্ধ করা যাবে না, কিন্তু পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা যাবে।  জাতীয় সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন যদি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ উন্নতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তখন স্বপ্নের আমেরিকার নাগরিকরাও বাংলাদেশে নাগরিত্ব নেওয়ার  আগ্রহ প্রকাশ করবে। সভ্য জগতে বাংলাদেশের রাজনীতি খুবই দুর্বল। আমাদের দেশে জনগণের জন্য একটিও গণতান্ত্রিক  রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেনি। গণতান্ত্রিক একজন নেতাও খুঁজে পাওয়া যায় না।  রাজনীতি আজ শুন্যের কোঠায় হওয়ার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা।  কী হওয়া সম্ভব? কীভাবে সফল হবে?  নতুন সভ্যতা সৃষ্টি করবে, তা রাজনীতিবিদদের চিন্তা-মনন জগতেই স্থান পায় না।  সবকিছু বিসর্জন দিয়ে শুধু  ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি। এটা কখনো রাষ্ট্র ও জাতির কল্যাণ হতে পারে না। রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণকে মিলিতভাবে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও জনমুখী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করলেই বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক সর্বজনীন কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

লেখকধ: এম এ আলীম সরকার 

প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিবিদ

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন