Logo
Logo
×

মতামত

পার্বত্য শান্তি চুক্তি: কী পেয়েছি আমরা?

Icon

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৮ পিএম

পার্বত্য শান্তি চুক্তি: কী পেয়েছি আমরা?

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্র পরিচালনায় বহু চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। তার মধ্যে সবচেয়ে জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী একটি সমস্যা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দাবি, পরিচয়, অধিকার- এসবকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে যে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, তা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে বহু বছর ধরে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে রাখে। কিন্তু এই আন্দোলন যে শুধুই স্থানীয় ইস্যুর ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, তা নয়। সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হয়েছে- পার্বত্য সংকটকে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত করে দেখা হয়। ভারত বরাবরই চেয়েছে, বাংলাদেশের গভীর দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে একটি চাপ বজায় থাকুক, যাতে তারা প্রয়োজনমতো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সুবিধা আদায় করতে পারে।

স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা যায়, পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তুলতে থাকে। তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে স্বায়ত্তশাসন, নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো ও ভূমি নিয়ন্ত্রণের বিশেষ অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় দাবি করে। ১৯৭০৮০’র দশকে এসব গোষ্ঠী অস্ত্র সংগ্রহ করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিভিন্ন রিপোর্টে বারবার উঠে আসে যে, ভারত তাদেরকে অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করেছে। উদ্দেশ্য একটাই- বাংলাদেশকে চাপে রাখা ও অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি করা।

এদিকে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সহিংসতা মোকাবেলায় অসংখ্যবার কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি- সব বাহিনীর বহু সদস্য সেখানে প্রাণ দিয়েছেন। সাধারণ মানুষও বছরের পর বছর ধরে ভয়, অনিশ্চয়তা আর বিচ্ছিন্নতার মধ্যে জীবন কাটিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নতুনভাবে আলোচনার উদ্যোগ নেয়। এর পরই ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত।

চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল- অস্ত্রবিরতি, স্থায়ী স্থিতিশীলতা, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা তৈরি, প্রশাসনকে স্থানীয় পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ এবং উন্নয়ন কার্যক্রমকে গতিশীল করা। তৎকালীন সরকার দাবি করেছিল, এ চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ সংঘাতের অবসান হবে, পাহাড়ে শান্তি ফিরবে এবং ধীরে ধীরে সবার মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। কিন্তু ২৮ বছর পর এসে প্রশ্ন উঠছে- চুক্তি থেকে বাংলাদেশ আসলে কী পেল? আমরা কি সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন অর্জন করতে পেরেছি?

১. চুক্তির বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে?

চুক্তিতে মোট ৪টি ভাগে প্রায় ৭০টির মতো ধারা ছিল। বলা হয়েছিল-

পাহাড়ে বিশেষ প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হবে,

ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কমিশন কাজ করবে,

সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র জমা দেবে,

সেনাক্যাম্প কমানো হবে,

পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সমঅধিকার নিশ্চিত হবে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো- এই ধারাগুলোর অনেক অংশ এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

ভূমি কমিশন কার্যকর হয়নি, প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনের অনেক বিষয় কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। এমনকি চুক্তির পরও বহু সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে, যারা পুরো পার্বত্যাঞ্চলকে আবার অস্থিরতার পথে নিয়ে যাচ্ছে।

২. শান্তি চুক্তির পরও কেন অশান্তি?

গত এক দশকে আমরা লক্ষ্য করেছি-

পাহাড়ে নতুন গ্রুপের উত্থান

চাঁদাবাজি, অপহরণ

পাকিস্তানি, ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা স্বার্থগোষ্ঠীর প্রবেশ

পাহাড়ি গ্রুপগুলোর নিজেদের মধ্যে সংঘাত

বাঙালি ও পাহাড়ি জনসংখ্যার মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি

চুক্তি বাতিলের দাবি করা

অর্থাৎ চুক্তি থাকার পরও বাস্তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। চুক্তি সই করা মানেই শান্তি আসে না- শান্তি আসে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, ন্যায়ভিত্তিক আইন প্রয়োগ ও আগ্রাসী বিদেশি প্রভাব মোকাবেলা করতে পারলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই তিন জায়গাতেই আমরা দুর্বল ছিলাম।

৩. ভারতের ভূমিকা: সমস্যা কোথায়?

বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বহুবার বলেছেন- ভারত পার্বত্য ইস্যুকে ‘স্ট্র্যাটেজিক লেভারেজ’ হিসেবে ব্যবহার করে।

কারণ:

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর

কক্সবাজার উপকূল

মিয়ানমারভারত করিডর

বাংলাদেশের রাজনীতি

অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি- এসব জায়গায় চাপ বজায় রাখতে পারলে ভারত কূটনৈতিকভাবে সুবিধা নিতে পারে। তাই পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আজও নানা মাধ্যমে ভারতের যোগাযোগ, অর্থ, অস্ত্র এবং রাজনৈতিক আশ্রয়- সবকিছু পেয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশ যদি চুক্তি করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হয়, তার কারণ হলো- পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা বহিরাগত হস্তক্ষেপ।

৪. সেনা উপস্থিতি কমানো কি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?

চুক্তির পর বলা হয়েছিল-

সেনা ক্যাম্প ধীরে ধীরে কমানো হবে

স্থানীয় প্রশাসন দায়িত্ব নেবে

পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে

কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে- সেনা কমানোর পরই বহু এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর আধিপত্য বেড়েছে। তারা নতুনভাবে শক্তিশালী হয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ি গ্রুপগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক আকারে যে ‘সশস্ত্র ব্যবসা’ তৈরি হয়েছে- চাঁদাবাজি, অপহরণ, অস্ত্র পাচার- এসবের নিয়ন্ত্রণ এখন আরও জটিল। বর্তমানে জনমতের একটি বড় অংশ, বিশেষজ্ঞরা, এমনকি স্থানীয় অনেকে পর্যন্ত দাবি করছেন- পাহাড়ে আবারও সেনা উপস্থিতি জোরদার করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা কোনো চুক্তির চেয়েও বড় বিষয়।

৫. পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অবস্থানকী পালটেছে?

চুক্তির পর আশা ছিল- পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা তৈরি হবে, তারা নিজেদেরকে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে দেখবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো-

আজও তারা নিজেদেরকে ‘আলাদা জাতিগোষ্ঠী’ দাবি করে

অনেকেই বাংলাদেশের সংবিধানকে মেনে নিতে চায় না

স্থানীয়ভাবে বাঙালিদের বিরুদ্ধে বর্ণবৈষম্যমূলক মনোভাব বজায় আছে

তারা প্রায়ই চুক্তি বাতিলের দাবি তোলে

বাঙালিদের বিরুদ্ধে হামলা, উচ্ছেদ, হুমকির ঘটনা ঘটে

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে- চুক্তি কি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে দেশের মূলধারায় আনতে সফল হয়েছে? উত্তর হলো- দুঃখজনকভাবে, না।

৬. বাংলাদেশ কী পেয়েছে?

চুক্তির ২৮ বছর পর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ যে জিনিসগুলো পেয়েছে- তাহলো কাগুজে শান্তি, কিছু রাজনৈতিক প্রচারণা, কিছুটা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি এবং পাহাড়কে ঘিরে আজও স্থায়ী অস্থিরতা। অর্থাৎ আমরা যে স্থিতিশীলতা চেয়েছিলাম, তা আসেনি। আমরা যে আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ আশা করেছিলাম, তা অনেক জায়গায় দুর্বল। যে জাতীয় নিরাপত্তা শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আজও প্রশ্ন রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা-

চুক্তির পর সৃষ্ট নতুন সশস্ত্র গ্রুপগুলো প্রমাণ করে, সমস্যার মূল জায়গা এখনো সমাধান হয়নি।

৭. তাহলে সমাধান কী?

এই মুহূর্তে বিশেষজ্ঞদের মূল সুপারিশগুলো হলো-

১. পাহাড়ে সেনা উপস্থিতি আবার শক্তিশালী করতে হবে। কারণ ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।

২. ভারতের সব ধরনের বেআইনি হস্তক্ষেপ কূটনৈতিকভাবে প্রতিহত করতে হবে।

৩. সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর কঠোর অভিযান চালাতে হবে।

৪. ভূমি কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে কার্যকর করতে হবে।

৫. পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বৈষম্যমূলক মনোভাব দূর করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

৬. উন্নয়ন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে।

২৮ বছর আগে ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’কে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বলা হয়েছিল। কিন্তু আজ যখন আমরা ফিরে তাকাই, তখন দেখি যে শান্তি আসার কথা ছিল, তার বড় অংশই বাস্তবে অনুপস্থিত। যে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। যে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল, তা সীমিত। এবং সবচেয়ে বড় কথা- যে জাতীয় নিরাপত্তা শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আজও বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। তাই আজ প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক

চুক্তি থেকে আমরা আসলে কী পেলাম? পাহাড় কি সত্যিই শান্ত হলো? নাকি শান্তির নামে আমরা আরও বড় নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেয়া হলো? বাস্তবতা হলোপাহাড় এখনো অশান্ত এবং অশান্তির মূল কারণ একই আর তা হচ্ছে বিদেশি হস্তক্ষেপ, সশস্ত্র গোষ্ঠীর পুনর্গঠন এবং দুর্বল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাই এখন আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। চুক্তি থাক বা না থাক- পাহাড়ে শক্ত রাষ্ট্রীয় উপস্থিতি এখন সময়ের দাবি। কারণ, রাষ্ট্রের এক ইঞ্চি ভূখণ্ডও অস্থিতিশীল রেখে শান্তি, উন্নয়ন বা কূটনৈতিক শক্তি- কোনোটিই অর্জন করা সম্ভব নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন