Logo
Logo
×

জাতীয়

কোটা আন্দোলন

সারা দেশে বিক্ষোভ–সংঘাত, নিহত ৬

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:৪০ এএম

সারা দেশে বিক্ষোভ–সংঘাত, নিহত ৬

চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় কোটা আন্দোলনকারীদের সাতে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ। ছবি : সংগৃহীত

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে গতকাল মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘাত চলার সময় ছয়জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে তিন, ঢাকায় দুই ও রংপুরে একজন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অনেকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর ও রাজশাহীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে।

অন্যদিকে দেশের সব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। আগামীকাল বৃহস্পতিবারের এইচএসসি পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে।

আন্দোলন ঠেকাতে আজ বুধবার সকাল থেকে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও সরকারি এ দলটির সহযোগী সংগঠনগুলো। অন্যদিকে ‘পুলিশ ও ছাত্রলীগের’ যৌথ হামলা ও গুলিতে শহীদদের জন্য সারা দেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল করবেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা।

কোটাবিরোধী আন্দোলনে গতকাল উত্তাল ছিল রাজধানী, স্থবির হয়ে পড়েছিল যান চলাচল। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, বগুড়াসহ দেশের প্রায় সব এলাকায়ই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে আসেন। অবরোধের কারণে ট্রেন চলাচলও ব্যাহত হয়। বেলা ১১টা থেকে রাজধানীর ১৫-২০টি স্থানে একযোগে সড়ক অবরোধ শুরু করেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রথমবারের মতো গতকাল মেডিকেল ও স্কুল শিক্ষার্থীরাও এ কর্মসূচিতে অংশ নেন। 

এদিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও অনুষদ ইউনিট থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় এ পদত্যাগের ঘটনা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের অন্তত ২২ জন নেতা-নেত্রী পদত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে পাঁচজন পদত্যাগ করেন গত রবিবার।

রাজধানী ঢাকার চিত্র

গতকাল দুপুরের পর থেকে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব ও চানখাঁরপুল এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। সায়েন্সল্যাব মোড়, গাবতলী-মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, নতুন বাজার, মধ্য বাড্ডা থেকে শুরু করে নদ্দা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, কুড়িল বিশ্বরোড, মহাখালী-বনানী সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। বিকালে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় শহীদুল্লাহ হল থেকে চানখাঁরপুল রোড। মহাখালীতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সংঘাত হয়। পুলিশ বক্সের সামনে দুটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে পুরো মহাখালী।

সায়েন্সল্যাব মোড়ে সিটি, আইডিয়াল ও ঢাকা কলেজসহ আরও কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা, গাবতলী-মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব), নতুন বাজার-সাঁতারকুল এলাকায় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ), মধ্য বাড্ডায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, নদ্দা-বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, কুড়িল বিশ্বরোডে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি), মিরপুর ১০ নম্বর মোড়ে বিইউবিটি ও মিরপুর বাঙলা কলেজ, মহাখালী-বনানী সড়কে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাঁতীবাজার এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বেইলি রোড মোড়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল এবং বাসাবো বৌদ্ধমন্দির এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন।

এদিকে গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আন্দোলনকারীদের হামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির পাঁচ সদস্য আহত হন। আহত শিক্ষকরা হলেনÑ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক ড. আব্দুল মুহিত, সহযোগী অধ্যাপক ড. ফারজানা আহমেদ (শান্তা), সহযোগী অধ্যাপক ড. হাসান ফারুক এবং সহকারী অধ্যাপক ইমামুল হক সরকার টিটু। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের সামনে আন্দোলনকারীরা তাদের ওপর হামলা করেন বলে জানান প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান।

ঢাকায় নিহত দুইজন 

রাজধানীর ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে নিউমার্কেট এলাকার হকার মো. শাহজাহান (২৫) নিহত হয়েছেন। গতকাল বিকালে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন এক পথচারী। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেন ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া।

তিনি বলেন, ‘গুরুতর আহত অবস্থায় এক যুবককে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার কানের নিচে ও মুখের বিভিন্ন জায়গায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।’ 

আহত যুবককে হাসপাতালে নিয়ে আসা পথচারী আকাশ মাহমুদ বলেন, ‘আমরা তাকে ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে পেট্রোল পাম্পের সামনে পড়ে থাকতে দেখি। এরপর হাসপাতালে নিয়ে আসি।’ 

পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এসে শাহজাহানের মরদেহ শনাক্ত করেন তার মা আয়েশা বেগম ও মামা মোসলেম উদ্দিন। তারা জানান, শাহজাহানের বাড়ি কেরানীগঞ্জের মীরেরবাগ পোস্তগোলা এলাকায়। তার বাবার নাম মৃত মহসিন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে শাহজাহান ছিলেন তৃতীয়। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরের চান মসজিদ এলাকায় থাকতেন।

এ ছাড়া সিটি কলেজের পাশে পপুলার হাসপাতাল থেকে মো. মনির নামের এক যুবককে গুরুতর আহত অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

চট্টগ্রামে নিহত তিনজন 

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষে চট্টগ্রামে গতকাল তিনজন নিহত হয়েছেন। তাদের মরদেহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘নিহতদের মধ্যে দুইজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। একজন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী আকরাম, অন্যজন ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী মো. ফারুক। অপরজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।’

আকরামের পুরো নাম ওয়াসিম আকরাম। তিনি চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আকরামকে আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মেহেরনামা বাজারপাড়া এলাকায়। তিনি ওই এলাকার প্রবাসী শফিউল আলম ও জোছনা আক্তারের ছেলে। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে ওয়াসিম দ্বিতীয়। তিনি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। 

নিহত মো. ফারুকের বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। তিনি নগরীর শোলকবহর এলাকার একটি ফার্নিচার দোকানে কাজ করতেন। দুই সন্তান ফাহিম ও ফাহিমা এবং স্ত্রী সীমা আখতারকে নিয়ে তিনি নগরীর লালখান বাজার এলাকায় থাকতেন।

সরেজমিনে জানা যায়, বেলা ৩টা থেকে নগরের মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট এবং ষোলশহরের আশপাশের এলাকায় কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষ শুরু হয়। এর আগে দুপুর থেকেই বিভিন্ন মোড়ে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। দুই নম্বর গেটের এলাকায় একটি বাস ভাঙচুর করেন তারা।

ষোলশহর শিক্ষা বোর্ড এলাকায় দুইপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে দীর্ঘ সময়। মুরাদপুর অংশে অবস্থান নেন কোটা আন্দোলনকারীরা। দুই নম্বর ও ষোলশহর এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র দেখা গেছে। আন্দোলনকারীদেরকেও লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান করতে দেখা যায়।

রংপুরে নিহত আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক 

গতকাল মঙ্গলবার রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আহত হন অন্তত ৭০ জন। 

আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে তার সহপাঠীরা জানান, কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুরের বাসিন্দা মকবুল হোসেনের ছেলে। তিনি গতকাল বিক্ষোভ মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশ টিয়ারগ্যাস, গুলি ও রাবার বুলেট ছুড়লে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ। পরে রংপুর মেডিকেলে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

গতকাল সকালে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল কলেজ, সরকারি কলেজ, জিলা স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থী একত্রিত হয়ে শহর থেকে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়ে পৌঁছায়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় ক্যাম্পাসে অবস্থান করা ছাত্রলীগ পিছু হটে।

সায়েন্সল্যাবে পাঁচ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ, আহত শতাধিক

রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টার পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান থেকে গুলি করা হয়েছে বলে কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন। এতে অন্তত পাঁচ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ ছাড়া সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহতদের পাশের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। 

গতকাল দুপুরে সায়েন্স ল্যাব এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর ২টার দিকে ওই মিছিলে হামলা চালান ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর থেকে ওই এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়। ঢাকা কলেজের ফটকের সামনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা হাতে রামদা, রড, লোহার পাইপ, লাঠি নিয়ে অবস্থান নেন। খানিক দূরে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তখন থেকে দুই পক্ষের মধ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ এবং পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। সন্ধ্যায় সেখানে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য হাজী সেলিমকে ধাওয়া করেন আন্দোলনকারীরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে চার শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ

রাজধানী ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) তিন শিক্ষার্থী এবং কবি নজরুল কলেজের এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। তাদের প্রথমে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালে, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করেন। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সিএমএম কোর্ট সংলগ্ন সড়কের সামনে পৌঁছলে তাদের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা ও গুলিবর্ষণ করে। এতে চার শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন।

গুলিবিদ্ধ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হলেনÑ মার্কেটিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের অনিক, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অন্তু এবং ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ফেরদৌস। আহত কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীর নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত জাবি অধ্যাপক

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও পুলিশ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে দুই অধ্যাপকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। গত সোমবার দিবাগত রাত পৌনে ৩টায় আন্দোলনকারীদের দমাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে পুলিশ গুলি চালালে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. খো. লুৎফুল ই এলাহী মারাত্মকভাবে আহত হন। তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সন্ধ্যায় আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ থামাতে গেলে আহত হন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আওলাদ হোসেন। 

এ ছাড়া রাতভর সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নুরুল আলমের বাসভবনে আশ্রয় নিলে তাদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। প্রথমে পুলিশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এসে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দিলে পুলিশও সংঘর্ষে জড়ায়। 

দিনভর উত্তপ্ত মতিঝিলের ব্যাংকপাড়া

কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গতকাল দিনভর উত্তপ্ত ছিল মতিঝিলের ব্যাংকপাড়া। নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের অবরোধে পুরো এলাকার যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। শাপলা চত্বর এলাকা বন্ধ থাকায় পুরো মতিঝিলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। আশপাশের ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়ে। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নিলে মিছিল বের করে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। এতে পুনরায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। এর আগে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের অবরোধ-বিক্ষোভের কারণে সকালে কর্মক্ষেত্রে আসতে অসুবিধায় পড়েন ব্যাংকাররা। 

ঢাকার বাইরে আরও সংঘর্ষ

গতকাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বাধা দেয় ছাত্রলীগ। এতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয় দুই পক্ষের। পরে পিছু হটে ছাত্রলীগ। তাদের বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দুপুরে রাজশাহী শহরের জিরো পয়েন্টে রাজশাহী কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় রাজশাহী মহানগর ও রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের। 

ফেনীর ট্রাংক রোডের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাম জোটের মানববন্ধনে হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। মানববন্ধনকারীদের মারধর করে তাদের ব্যানার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। 

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রায় তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে কুমিল্লা পলিটেকনিক কলেজ, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, সিসিএন শিক্ষা পরিবারের শিক্ষার্থীসহ কুমিল্লা শহরের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ করলে পুলিশ রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়ে। এতে কুমিল্লা জেলা স্কুলের দুই শিক্ষার্থী আহত হন। পরে উত্তেজিত অবরোধকারীরা পুলিশের গাড়ি ও একটি মোটরসাইকেলে ভাঙচুর করেন।

নরসিংদীর জেলখানা মোড়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এর আগে বেলা সাড়ে ৩টায় তারা ঘটনাস্থলে একত্রিত হতে চাইলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাধা দেয়। এ সময় ছাত্রলীগ ও কোটাবিরোধীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিকাল সাড়ে ৪টায় ছাত্রলীগ পিছু হটলে শিক্ষার্থীরা সেখানে অবস্থান নেন। 

কক্সবাজারে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়েছে ছাত্রলীগের। এ সময় ছাত্রলীগের চার নেতাকে মারধর করা হয়। পরে পিছু হটে ছাত্রলীগ। আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ, জাসদ, জাতীয় পার্টির কার্যালয়সহ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং গাড়ি ভাঙচুর করেন। 

বান্দরবান শহরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের করলে ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। 

বেলা সাড়ে ১১টায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা দিনাজপুর সরাকারি কলেজ মোড়ে অবস্থান নেন। এ সময় দিনাজপুর-দশ মাইল মহাসড়ক অবরোধ করলে তাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ। উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ চলে ঘণ্টাব্যাপী। এতে শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ১২ জন আহত হন। 

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বগুড়ায় টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এর আগে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বেলা ৩টা থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সাতমাথা এলাকায় অবস্থান করেন। তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে হটে যায়। এ সময় আওয়ামী লীগ অফিস ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান রনির কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুরসহ ছয়টি মোটরসাইকেল, সাতমাথা পুলিশ বক্স ভাঙচুর করা হয়। এই ঘটনায় চার সাংবাদিক ও এক পথচারী আহত হন। এ ছাড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ককটেল বিস্ফোরণে দুই শিক্ষার্থী আহত হন। 

ঝিনাইদহ শহরের উজির আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলা করে ছাত্রলীগ। লাঠি-রড দিয়ে শিক্ষার্থীদের মারধর করে ব্যানার কেড়ে নেয় তারা। হামলায় অন্তত পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হন। 

কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ ও শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে হামলা করে ছাত্রলীগ। এই ঘটনায় অন্তত ১৮ জন আহত হয়েছেন। পরে এর প্রতিবাদে শহরে লাঠি নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

নওগাঁয় শিক্ষার্থীদের সমাবেশে হামলা চালিয়ে পণ্ড করে দেয় ছাত্রলীগ। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নওগাঁ মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের ডাকা সমাবেশে এই হামলায় নওগাঁ মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমানসহ অন্তত ছয়জন গুরুতর আহত হয়েছেন। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন। 

বরিশালে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। বিক্ষুব্ধদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে পুলিশ। বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গাজীপুরের কোনাবাড়িতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক আড়াই ঘণ্টা অবরোধ করেন মোহাম্মদ ইমারত হোসেন আরিফ কলেজের শিক্ষার্থীরা। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের (শজিমেক) শিক্ষার্থীরা কলেজের সামনে বিক্ষোভ করে বগুড়া-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ করেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 

এ ছাড়া গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। 

যশোরে জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। 

ছাত্রলীগ শেষ দেখে ছাড়বে : সাদ্দাম 

ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে নিয়ে ন্যূনতম বক্তৃতা বিবৃতি, কোনো বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা হলে ছাত্রলীগ শেষ দেখে ছাড়বে। ছাত্রলীগের ওপর হামলাকারী ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের রুখে দিতে ছাত্রলীগ বদ্ধপরিকর। 

ছাত্রলীগ সভাপতি আরও বলেন, আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে; কিন্তু ছাত্রলীগ থাকবে। সবকিছু মনে রাখা হবে এবং জবাব দেওয়া হবে। একটি ঘটনাও জবাব ছাড়া যাবে না।

সাদ্দাম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে আর কোনো সাধারণ শিক্ষার্থী নেই। কোটা ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনকারী নেই। এখন যারা রয়েছেন, তারা রাজাকারদের প্রেতাত্মা। এরা কোটা সমস্যার সমাধান চান না। তারা শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে রাজাকারের রাজনীতি পুনর্বাসন করতে চান।

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন