বাড়ছে বন্যাদুর্গত এলাকা, পানিবন্দি লাখো মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:৩১ পিএম
বাড়ছে পদ্মা নদীর পানি। ছবি : সংগৃহীত
দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি নদীর পানি বাড়তে থাকায় সেখানকার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আবার অবনতি হয়েছে। চলতি মৌসুমে তৃতীয় দফায় বন্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে সুনামগঞ্জবাসীকে। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, রাজবাড়ীতেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। রংপুরে ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ৯টি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গবাদিপশুর খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সহায়তা পাঠানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
গতকাল শুক্রবার বন্যাদুর্গত অঞ্চল থেকে প্রতিণিধিদের পাঠানো সংবাদ এবং বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সুনামগঞ্জের ফের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
সুনামগঞ্জ প্রতিবেদক জানান, অবিরাম বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে চলতি মৌসুমে তৃতীয়বারের মতো বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে সুরমা নদীর পানি আবারও বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গত দুই দিনে হাওর ও নদীতে পানি বেড়েছে। এ কারণে নতুন করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তাহিরপুরে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামছে বেশি। গতকাল সকালে ঢলের পানিতে উপজেলার আনোয়ারপুর থেকে উপজেলা সদর সড়কের চিকসা পর্যন্ত প্লাবিত হয়েছে। এর আগে সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের আনোয়ারপুর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শক্তিয়ারখলা ও দুর্গাপুর এলাকা প্লাবিত হয়। এই সড়ক দিয়ে প্রায় এক মাস সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। প্লাবিত স্থানে নৌকায় পারাপার হচ্ছে লোকজন।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সুরমা নদীতীরবর্তী মল্লিকপুর, বড়পাড়া, তেঘরিয়া, উত্তর আরপিননগর, ষোলঘর, ফিরোজপুর এলাকার রাস্তাঘাট ও কিছু ঘরবাড়ি আবার প্লাবিত হয়েছে। শহরে কালীপুর, শান্তিবাগ এলাকা থেকে বন্যার পানি এখনও নামেনি।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢল নেমে সীমান্তবর্তী নদী, ধোপাজান, যাদুকাটা ও পাটলাই নদী এবং খাসিয়ামার, চেলা নদী দিয়ে দ্রুতবেগে পানি প্রবাহিত হয়ে সুরমা বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এ ছাড়া পানি বেড়েছে হাওরে। এতে এ অঞ্চলের লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পাউবোর তথ্য মতে, গতকাল দুপুর ১২টায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর এলাকায় সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই সময়ে ছাতক উপজেলা শহরের কাছে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার জামালগঞ্জ, শান্তিগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা উপজেলায় এখনও বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এখন আবার ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানি বাড়ছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেছেন, উজানের ঢল নামছে, একই সঙ্গে ভারী বৃষ্টিও হচ্ছে। তাই পানি আরও বাড়তে পারে।
সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
সিরাজগঞ্জ প্রতিবেদক জানান, যমুনা নদীর পানিসহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল সকালে শহররক্ষা বাঁধ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে যমুনার সঙ্গে জেলার অভ্যন্তরীণ করতোয়া, ফুলঝোড়, বড়াল নদ ও চলনবিলের পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। যমুনা ও অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। ফলে চরম দুর্ভোগে রয়েছে বন্যাকবলিত এলাকার কৃষক ও শ্রমজীবীরা।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান, যমুনা নদীর পানি আরও অন্তত দুদিন বৃদ্ধি পেতে পারে।
জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতি
জামালপুর প্রতিবেদকের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে জামালপুরে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। গতকাল সকাল ৯টার দিকে যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জেলার সাতটি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, বকশীগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার ৪০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ২ লাখ ৫০ হাজার ২২৮ মানুষ বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
দুর্গত এলাকার জমির ফসল, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় বেশিরভাগ এলাকায় পানি জমে থাকার কারণে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এখনও নিরূপণ করা যায়নি। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাকিয়া সুলতানা জানান, পানিতে তলিয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির ফসলের মধ্যে পাট ও আখ ছাড়া অন্য সবই নষ্ট হয়ে গেছে।
রাজবাড়ীতে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে
রাজবাড়ী প্রতিবেদক জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে জেলার সকল নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার ছয়টি পয়েন্টেই নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ১৪ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া জেলার প্রত্যেকটি নদ-নদীতে প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটারের বেশি পানি বাড়ছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে অচিরেই জেলার নিম্নাঞ্চলগুলোতে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দৌলতদিয়ার পানি পরিমাপক (গেজ পাঠক) সালমা খাতুন জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে রাজবাড়ী জেলার সকল নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (১১ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ১২ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত) ১৪ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানির লেভেল রয়েছে ৭ দশমিক ৯৩ সেন্টিমিটার, এই পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ৭ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার। গোয়ালন্দে পদ্মার পানি বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য নদীর পানিও বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।
রাজবাড়ী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সৈয়দ আরিফুল হক জানান, বন্যার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে সভা করেছেন। তাদের ব্যাপক প্রস্তুতিও রয়েছে। এখন পর্যন্ত জেলার কোথাও বন্যা ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাননি। তারপরও প্রস্তুতি হিসেবে ১২টি ফ্লাড শেল্টার প্রস্তুতের পাশাপাশি ৬০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১২ লাখ টাকা মজুত রাখা হয়েছে।
কুড়িগ্রামে আবারও পানি বাড়ছে, দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের
কুড়িগ্রাম প্রতিবেদকের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কুড়িগ্রামের ১৬টি নদনদীর পানি গত দুদিন ধরে কিছুটা কমে আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ফলে জেলার ৯টি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের প্রায় দুই লাখ পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর গবাদিপশুর খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম চলমান থাকলেও গোখাদ্যের সংকট নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে বানভাসীরা।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার নদের ৪টি পয়েন্টের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দেওয়া তথ্য অনুসারে ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া ধরলা নদীর পানি বিপদসীমা সীমার ১৮ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদের পানি ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গত ১০ দিন ধরে জেলার ৯টি উপজেলার দুই লাখ পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। রাস্তাঘাট তলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কয়েক দিনের বন্যায় নাগেশ্বরী উপজেলার দুটি বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চর দ্বীপ চর ও নিম্নাঞ্চলের মানুষ ঘরে চাল-ডাল থাকার পরেও রান্না করে খেতে পারছেন না। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবার নিয়ে উঁচু স্থানে অবস্থান করছে। অনেকে নৌকার ভেতর রাত কাটাতে হচ্ছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই সরকার বলেন, জেলার বন্যাকবলিতদের জন্য গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৫৪২ মেট্রিক টন চাল, ৩২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও ২৩ হাজার ১২০ প্যাকেট শুকনো খাবার ৯ উপজেলায় বিতরণ চলমান রয়েছে।
রংপুরে তিস্তা নদীর পানি কমছে
রংপুর অফিস জানায়, রংপুরে তিস্তা নদীর পানি কমছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় নদীর পানি কমেছে ৪৩ সেন্টিমিটার। এতে করে নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের প্লাবিত কিছু এলাকা থেকে পানি সরছে। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ২৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের তথ্য জানিয়েছে রংপুর আবহাওয়া অফিস। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, নদীর উজানে ভারতে ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বৃহস্পতিবার দিনভর তিস্তা নদীর পানি ২০ সেন্টিমিটার কমে যায়। শুক্রবারও পানি কমতে থাকা অব্যাহত থাকে। শুক্রবার সকাল ৬টায় কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দিনভর ১২ সেন্টিমিটার পানি কমে সন্ধ্যা ৬টায় বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, আবহাওয়া সংস্থার তথ্য মতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চল ও এর উজানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এতে করে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।