
প্রিন্ট: ১৬ মার্চ ২০২৫, ০১:১১ পিএম

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৪ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বর্তমানে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, দেশের বর্তমান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা টেকসই নীতির সঙ্গে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শহরাঞ্চলে প্রায় ৫৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্য উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে, যা পরিবেশদূষণ, জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে।
বাংলাদেশে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো থাকলেও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব প্রকট। এখানকার মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদন প্রতি বছর প্রায় ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ হাজার টনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে ১২,৪৩৫ টন বর্জ্য বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মাত্র ৪০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় এবং মাত্র ১০ শতাংশ পুনঃব্যবহারযোগ্য করা হয়। অথচ বাংলাদেশে এখনো কার্যকরী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নেই।
ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ৬,৫০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা ২০৩২ সাল নাগাদ বেড়ে ৮,৫০০ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কেবলমাত্র ঢাকায় প্রতিদিন হাসপাতালের প্রতি শয্যায় ১.৬৩ থেকে ১.৯৯ কেজি মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির পর এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) ২০১৫-২০২১ সালের মধ্যে কক্সবাজারে পাঁচটি মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র স্থাপন করলেও, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক।
জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসেস (UNOPS) আয়োজিত একটি গোলটেবিল আলোচনায় পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এসডিজি ১১, ১২ এবং ১৩ বাস্তবায়নের জন্য বর্জ্য উৎপাদন কমানোর লক্ষ্যে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. রওশন মমতাজ এই আলোচনায় বলেন, প্রতি ১৫ বছরে বর্জ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং অপরিকল্পিত ল্যান্ডফিল ব্যবস্থার কারণে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
তিনি থ্রিআর মডেল—হ্রাস, পুনঃব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের (Reduce, Reuse, Recycle) ওপর গুরুত্ব দেন এবং এক্সটেন্ডেড প্রডিউসার রেসপনসিবিলিটি (ইপিআর) বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মী পুনঃব্যবহারযোগ্য মেডিকেল বর্জ্য (যেমন সিরিঞ্জ, ব্লাড ব্যাগ, স্যালাইন ব্যাগ) অপরিশোধিত অবস্থায় অবৈধ পুনর্ব্যবহারকারীদের কাছে বিক্রি করে।
২০০৮ সালের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইনে প্লাস্টিকের টিউব ও অন্যান্য উপকরণ কেটে ফেলার নিয়ম থাকলেও, গবেষণায় দেখা গেছে যে ৩১ শতাংশ হাসপাতাল এই নিয়ম মানে না, এবং ৪৯ শতাংশ হাসপাতালের সুই ধ্বংসকারী যন্ত্র নেই।
একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিয়ে কথা বলতে চায় না। অনেক হাসপাতাল উচ্চ ব্যয় এবং প্রযুক্তির অভাব দেখিয়ে সাধারণ আবর্জনার সঙ্গে মেডিকেল বর্জ্য ফেলে দেয়, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় না থাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, "জবাবদিহিতার অভাব এবং প্রশাসনিক দুর্নীতি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে, যার ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ দুটোই হুমকির মুখে পড়ছে।"
সম্ভাব্য সমাধান ও নীতিগত সুপারিশ
মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।
থ্রিআর নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে বর্জ্য হ্রাস ও পুনঃব্যবহারের হার বাড়ানো যায়।
এক্সটেন্ডেড প্রডিউসার রেসপনসিবিলিটি (ইপিআর) মডেল বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে উৎপাদকরা তাদের তৈরি বর্জ্যের দায় নেয়।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রযুক্তি-নির্ভর বর্জ্য ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করতে হবে।
বাংলাদেশে কঠিন ও মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সংকট কেবল পরিবেশ নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও এক ভয়াবহ হুমকি হয়ে উঠেছে। কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ছাড়া ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠবে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে, এক ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে দেশ।