আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত নভেম্বরে একসঙ্গে ৫২ জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেয় সরকার। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ দফায় ২৫তম ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নতুন করে ২৮তম ও ২৯তম ব্যাচের কর্মকর্তাদেরও ডিসি পদে পদায়ন করা হয়।
তবে নিয়োগের কিছুদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকজন ডিসির বিরুদ্ধে দলীয় পরিচয়ের অভিযোগ, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং ‘ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা’র অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে ছয় জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ আসায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অনেকটা বাধ্য হয়েই দ্রুত এই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আরও কয়েকজন জেলা প্রশাসক (ডিসি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সম্পর্কে বদলি বা প্রত্যাহারের সুপারিশ করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এদিকে গতকাল রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইংয়ে একাধিক কর্মকর্তাকে পদায়নের আদেশ বাতিলের তদবির করতে দেখা গেছে। সম্প্রতি প্রশাসনের ২৯তম ও ৩০তম ব্যাচের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় উপপরিচালক (ডিডিএলজি) পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্বাচনের আগে এই দায়িত্বে যেতে অনীহা প্রকাশ করছেন অনেক কর্মকর্তা। তাদের আশঙ্কা, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হলে ভবিষ্যতে হয়রানি, পদোন্নতি বা পরবর্তী পদায়নে জটিলতা দেখা দিতে পারে। কেউ কেউ পারিবারিক সমস্যার কথাও জানিয়েছেন।
এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে দুজন বিভাগীয় কমিশনার, ৬৪ জন জেলা প্রশাসক এবং তিনজন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তফসিল ঘোষণার পরই নির্বাচন কমিশন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একটি ডিও লেটার পাঠিয়ে জানায়, তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিন পর্যন্ত নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি, পদায়ন বা ছুটি প্রদানে ইসির সম্মতি নিতে হবে। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের পূর্বানুমতি ছাড়া নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে বদলি না করার অনুরোধ জানানো হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পাঠানো চিঠিতে।
নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তফসিল ঘোষণার পর এই ডিও লেটার প্রশাসনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর ফলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ সদর দপ্তরে প্রয়োজনীয় পরিপত্র জারি করা হবে, যাতে প্রশাসনের ওপর নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক কর্তৃত্ব কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ডিও লেটারে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রয়োজনে বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে। একই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হবে। এ অবস্থায় হঠাৎ বদলি বা দায়িত্ব পরিবর্তন নির্বাচন কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটাতে পারে বলে নির্বাচনকালীন পুরো প্রশাসনিক কাঠামো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় কমিশন।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, মাঠ প্রশাসনের রদবদল একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেও তফসিল ঘোষণার পর প্রয়োজন অনুযায়ী কমিশন ব্যবস্থা নেবে। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই তাদের লক্ষ্য। নির্বাচনকালীন সময়ে বদলি, প্রত্যাহার বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করবে নির্বাচন কমিশন এবং তা বাস্তবায়ন করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এরই মধ্যে প্রশাসনে কিছু রদবদল হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পর্যায়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর ৩১ জনকে নতুন করে এডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে ৫৯৪ উপজেলার মধ্যে ২৪৩ উপজেলায় নতুন ইউএনও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সাবেক আমলা ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুস সবুর বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত। নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে এমন কোনো বিষয় তারা বরদাশত করবে না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা কমিশনের সাংবিধানিক অধিকার।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের সুপারিশে প্রশাসনে আরও বড় ধরনের রদবদল হতে পারে। ইসির সুপারিশ অনুযায়ী বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও এডিসিদের বদলি-পদায়নের আদেশ দেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, আর ইউএনও ও ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষেত্রে আদেশ আসবে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে।



