একই দিনে নির্বাচন–গণভোটের ঘোষণায় সংবিধান সংস্কার নতুন মোড়ে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১১:২৪ এএম
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। জনগণের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তরই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ সংবিধান সংস্কারের ভবিষ্যৎ রূপরেখা। তার এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন নতুন ধারায় প্রবেশ করল।
জুলাই সনদের সার্বিক অগ্রগতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলো সনদে স্বাক্ষর করে। এরপর ২৮ অক্টোবর ঐকমত্য কমিশন তাদের বাস্তবায়ন-সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। আর ১৩ নভেম্বর গণভোটের ঘোষণা দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নকে সাংবিধানিক কাঠামোর অংশ করার ঘোষণা আসে। ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ ইতোমধ্যে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
এই তিন ধাপে—দলীয় স্বাক্ষর, বাস্তবায়ন-সুপারিশ এবং সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত—ক্রমাগত বদলেছে সনদের ভাষা, কাঠামো ও রূপ। প্রথম খসড়ায় ছিল ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব; দলগুলোর আলোচনায় তা নেমে আসে ৩০টি ঐকমত্যভিত্তিক বিষয়ে। এরপর সরকারের সিদ্ধান্তে চারটি মৌলিক বিষয়ে একক প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের বিধান যুক্ত হয়। ফলে জুলাই সনদ এখন শুধু একটি সংস্কার দলিল নয়—এটি দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের নতুন নকশা।
দলগুলোর সইয়ে তৈরি হয় ৩০-দফা ঐকমত্য
৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের অংশগ্রহণে গঠিত হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ’—যা রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমনে বড় পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়। শুরুতে অন্তর্ভুক্ত ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ২৫টি দল ১৭ অক্টোবর সই করে। তারা প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় থাকুক বা বিরোধীতে—এই সংস্কার বাস্তবায়নে অঙ্গীকার স্থির থাকবে। সেখানেই সনদটি পায় ‘জাতীয় ঐকমত্য’ পরিচয়।
তবে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে তখনও মতপার্থক্য ছিল। কেউ চাইছিল সংসদের মাধ্যমে, কেউ চাইছিল সংসদ-পূর্ব গণভোটের মাধ্যমে। প্রথম খসড়ায় যুক্ত ছিল ‘নোট অব ডিসেন্ট’, যা পরবর্তী ধাপগুলোতে বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ও বাদ পড়া ভিন্নমত
২৮ অক্টোবর অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে যে বাস্তবায়ন-সুপারিশ জমা দেয়, তাতে দুটি বিকল্প পরিকল্পনা ছিল।
প্রথম বিকল্পে বলা হয়—বিশেষ সরকারি আদেশের ভিত্তিতে গণভোট হবে, এবং তা পাস হলে পরবর্তী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে। দ্বিতীয় বিকল্পটি ছিল প্রায় একই রকম, তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে কী হবে তা উল্লেখ করা হয়নি।
এই ধাপের সবচেয়ে আলোচিত সিদ্ধান্ত ছিল দলগুলোর নথিবদ্ধ ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বাদ দেওয়া। অন্তত ৯টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভিন্নমত থাকলেও সেগুলো চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এই ইস্যুগুলো ছিল—
১. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি,
২. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ,
৩. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ,
৪. সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব,
৫. সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের ভূমিকা,
৬. নারীর কোটা,
৭. ন্যায়পাল নিয়োগ পদ্ধতি,
৮. মহা হিসাব-নিরীক্ষকের ক্ষমতা,
৯. দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা।
নথি থেকে ভিন্নমত বাদ দেওয়ায় রাজনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দলগুলো মন্তব্য করে—‘ঐকমত্যের নামে ভিন্নমতকে চাপা দেওয়া হয়েছে।’
সরকারের সিদ্ধান্ত ও নির্বাচন–গণভোট এক দিনে
দলগুলোর মধ্যকার মতভেদ না মিটলে সরকার নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে অগ্রসর হয়। তারই পরিণতি ১৩ নভেম্বরের ঘোষণা—একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, জুলাই সনদের ৩০টি ঐকমত্যভিত্তিক প্রস্তাবের মধ্যে ৪টি বিষয়ে একক প্রশ্নের মাধ্যমে জনগণের মত নেওয়া হবে। চারটি ইস্যু হলো—
১. শাসনব্যবস্থা (সংসদীয় না মিশ্র),
২. প্রধান নির্বাচন কমিশনের গঠন,
৩. প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো,
৪. বিচার বিভাগের নিয়োগ ও জবাবদিহি।
এছাড়া তিনি স্পষ্ট করেন, জাতীয়ভাবে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আইনসভার উচ্চকক্ষ গঠিত হবে।
জুলাই সনদের রাজনৈতিক তাৎপর্য
জুলাই সনদের তিন ধাপ—দলীয় সই, কমিশনের সুপারিশ ও সরকারের বাস্তবায়ন সিদ্ধান্ত—বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনে নতুন দিকচিহ্ন। এতে যেমন দলগুলোর বহু বিতর্কিত বিষয়ে ঐকমত্য উদ্ভূত হয়েছে, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারের সক্রিয় ভূমিকা সংবিধান সংস্কারে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ধারণা দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত জুলাই সনদ এখন কেবল একটি সংস্কার প্রস্তাব নয়; এটি নির্বাচনের পাশাপাশি জাতীয় গণভোটের কেন্দ্রীয় দলিল—যা নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র ও সংবিধানের পরবর্তী পথ।



