জুলাই গণঅভ্যুত্থান : প্রত্যাশা-প্রাপ্তি নিয়ে দ্বিধায় সাধারণ মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ০১:৩৫ পিএম
ফাইল ছবি
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। পতন ঘটে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা ফ্যাসিস্ট শাসনের। আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা ছাত্র-জনতা, সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা ছিল একটি নতুন, মুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সূচনা।
কিন্তু এক বছর পর সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে। আছে আশার আলো, আছে অনিশ্চয়তার ছায়াও।
রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. শিহাবুল তালাত। ২৬ বছর ধরে মোটরসাইকেল ব্যবহার করলেও এখন তা ছেড়ে দিয়েছেন নিরাপত্তার অভাবে।
শিহাবুল বলেন, ‘আমি নিজে বাইক ছিনতাই হতে দেখেছি। এখন আর বাইক নিয়ে বের হই না। কারণ, শুধু বাইক গেলে ঠিক আছে, কিন্তু ছিনতাইকারীরা শরীরে কোপ দেয়, আঘাত করে। এটাই ভয়, যত রাতই হোক মতিঝিল থেকে বাসে আসি।’
তিনি বলেন, ‘খুব যে পরিবর্তন হয়েছে তাও না, আবার একেবারে যে কিছুই হয়নি সেটাও ঠিক না। এখন রাতে বের হলে স্ত্রী চিন্তায় থাকেন। তাকেও বাসার কাছাকাছি একটা হাসপাতালে ট্রান্সফার করিয়ে এনেছি। তিনি আগে উত্তরার একটি হাসপাতালের কাজ করতেন।’
এখনো চাঁদাবাজি এবং মানুষের ওপর নির্যাতন নিয়ে হতাশ আন্দোলনকারী মো. জিল্লুর রহমান। স্বৈরাচার পতনের পর যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বা নিরাপত্তা প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা এখনো অনেকাংশে অপূর্ণ।’ যোগ করেন শিহাবুল তালাত।
কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের পাশের একটি চায়ের দোকানে কলা-রুটি খেতে খেতে চাকরিজীবী সোহানুর রহমান বলেন, ‘৫ আগস্ট যেভাবে সবাই একসঙ্গে ছিল, এখন সেই ঐক্য নেই। রাজনৈতিক দলগুলো আবার নিজেদের মধ্যে বিভক্ত।’
তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের অনুপ্রেরণা নষ্ট করেছেন রাজনীতিবিদরা। মানুষ দেশ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু এখন সেই স্বপ্ন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার লোভ ও মতপার্থক্যের কারণে।’
আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশের অর্থনীতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এর ফলাফল নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
কাজীপাড়ার মেট্রো স্টেশনের নিচে কথা হয় চা-সিগারেট বিক্রেতা জুয়েলের সঙ্গে। দুই বছর ধরে ফুটপাতে ব্যবসা করছেন তিনি।
জুয়েল বলেন, ‘আগে পুলিশ, সন্ত্রাসী, নেতা—সবাই চাঁদা নিত। এখন কেউ টাকা নেয় না। এক বছর হলো শান্তিতে ব্যবসা করছি।’
তবে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার কথা জানান রিকশাচালক মো. শাহীন ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে দুই টাকা পথচাঁদা দিতাম, এখন দিতে হয় ১০ টাকা। আগে যা ছিল ১০ টাকা, এখন ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এত রক্ত দিলাম, তবুও সুফল পাই না।’
শাহীন ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার বলে পুলিশ ঠিকমতো কাজ করছে না। আবার ছাত্ররা যাদের ট্রাফিকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারাও টাকা নিচ্ছে। আগে সার্জেন্ট নিত, এখন ছাত্ররা নিচ্ছে।’
সাতক্ষীরা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা আন্দোলনকারী মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে আহত হই। আমরা আন্দোলন করেছিলাম দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের জন্য। এখনো চাঁদাবাজি হয়, মানুষের ওপর নির্যাতন হয়। এটা তো চাওয়া ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজি এখনো এক বিষাক্ত ফোঁড়া। প্রশাসনকে এই ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।’
এতকিছুর পরও অনেক ক্ষেত্রে উন্নতির কথা জানিয়েছেন নাগরিকরা। তাদের মতে, রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়েছে, অধিকার সম্পর্কে মানুষের স্পষ্ট অবস্থান তৈরি হয়েছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে জবাবদিহির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এখনো সময় চায়। বিশেষ করে বিচারব্যবস্থার সংস্কার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কিন্তু বড় আন্দোলনের পর একটি বড় প্রত্যাশার ভার তৈরি হয়। সেই প্রত্যাশার ভার কতটা টানতে পারবে নতুন রাষ্ট্রীয় কাঠামো—সেই প্রশ্ন এখন মুখে মুখে।
শুধু সরকার নয়, আন্দোলনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমেরও দায়িত্ব—এই চেতনা ও প্রত্যাশাকে ব্যর্থ হতে না দেওয়া।



