ঊনসত্তরে হেলাল হাফিযের যে কবিতা আলোড়ন তুলেছিল
যুগের চিন্তা ২৪ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৮ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়'-লিখে বাংলা কবিতায় অমরত্ব পাওয়া কবি হেলাল হাফিজ মারা গেছেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডা. মোঃ রেজাউর রহমান বলেছেন, শুক্রবার বিকাল ৩টার দিকে হেলাল হাফিজ যে হোস্টেলে থাকতেন, সেখানকার লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল।
জীবদ্দশায় তার মাত্র দুইটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম বই 'যে জলে আগুন জ্বলে' রাজনৈতিক ভাষা আর আবেগের মিশেলে প্রকাশের পরপরই তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত বইটির বৈধ মুদ্রণই হয়েছে ৩৩ বারের বেশি। রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে তার কবিতার পঙতি যেমন ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি আশির দশকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক প্রতিচ্ছবি বলা হয় তার কবিতাকে। হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তারো ১৭ বছর আগে তার কবিতা 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় তার লেখা ওই কবিতার প্রথম দুইটি লাইন 'এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়; এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,' রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয় এবং এখনো পর্যন্ত এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহৃত রাজনৈতিক স্লোগান। হেলাল হাফিজ নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কবিতাটি ওই সময় কোনো পত্রিকা প্রকাশ করার সাহস পায়নি। কিন্তু কবিতার প্রথম দুটি লাইন আহমদ ছফা এবং কবি হুমায়ুন কবির ১৯৬৯ সালে একরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়াল লিখন করে দিয়েছিলেন।
এরপর ছাত্রাবস্থাতেই কবি হিসেবে তারকা খ্যাতি পেয়ে যান হেলাল হাফিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে হেলাল হাফিজের দুই ব্যাচ জুনিয়র ছিলেন কবি শামীম আজাদ, কিন্তু তারা বন্ধু-প্রতিম এবং সমসাময়িক সাহিত্যিক ছিলেন। কবি হিসেবে হেলাল হাফিজকে 'বিরল-প্রজ' একজন কবি বলে মনে করেন শামীম আজাদ। উনি কম লিখেছেন কিন্তু প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন। কবিতা ছিল ছোট কিন্তু ভাব ভাব প্রকাশ করতে সেগুলো। হেলাল হাফিজকে বলা হয় প্রেম আর দ্রোহের কবি।
তিনি ছিলেন প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন, কিন্তু চরিত্রে ছিলেন বোহেমিয়ান। বিয়ে করেননি কোনদিন। জীবনের বড় একটি সময় কাটিয়েছেন তোপখানা রোড আর সেগুনবাগিচার আবাসিক হোটেলে, রোজ খেতে যেতেন জাতীয় প্রেসক্লাবে। কিন্তু সাহিত্য সমালোচকেরা মনে করেন তার ব্যতিক্রমী ও অপ্রচলিত জীবন তার কবিতায় ছাপ ততটা রাখেনি, বরং তার কবিতা ছিল সরল আর প্রাঞ্জল। কবি এবং সাংবাদিক হাসান হাফিজ বলেছেন, কবিতার বিরুদ্ধে সাধারণভাবে দুর্বোধ্যতার যে অভিযোগ সেটি হেলাল হাফিজের বেলায় একেবারেই ছিল না।
এক্ষেত্রে তার শক্তি ছিল সহজ সরল ভাষায় মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা। উনি সরল ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতেন, আর তার ফলেই মানুষের একেবারে কাছে পৌঁছে গেছেন তিনি। হেলাল হাফিজের জন্ম নেত্রকোনায় ১৯৪৮ সালের ৭ই অক্টোবর। তিনি সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেছেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে খুব শান্ত আর অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তবে কবি শামীম আজাদ বলেছেন, হেলাল হাফিজ ছিলেন যে কোন আড্ডার প্রাণ। ব্যক্তিগতভাবে ও ছিল খুবই শান্ত চুপচাপ ধরণের, কিন্তু আড্ডার প্রাণ ছিল।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, এর মধ্যে ২০১৩ সালে তিনি কবিতায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। তার দ্বিতীয় এবং শেষ কাব্যগ্রন্থ 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।কবির কলম থেমে গেলেও হেলাল হাফিজ বাংলা কবিতায় প্রাসঙ্গিক থাকবেন আরো অনেক বছর সে কথা সহজেই বলা যায়।