Logo
Logo
×

শিক্ষা

মায়ের তরীর গুরুগৃহে গান ও বাদ্যযন্ত্র শিখছে ৬শ শিশু

Icon

রাজু মোস্তাফিজ,কুড়িগ্রাম

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:০০ পিএম

মায়ের তরীর গুরুগৃহে গান ও বাদ্যযন্ত্র শিখছে ৬শ শিশু

বাংলাদেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে গড়ে উঠেছে লোকগান ও লোক সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র ‘মায়ের তরী’। এই সংগঠনের উদ্যোগে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলায় ৬ শতাধিক শিশু শিখছে লালনগীতি, মারফতি, মুর্শিদী, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতিসহ বিভিন্ন লোকগান।

শিখছে বাশি, দোতরা, একতারা, খমোক, সারিন্দা, তবলা, বাংলাঢোল, বেহালাসহ বিভিন্ন লোক বাদ্যযন্ত্র। আধুনিক, মেলোডি আর ব্যান্ডের এমন রঙিন হাতছানির মধ্যেও মায়ের তরীর এমন উদ্যোগে ব্যাপক সারা জাগিয়েছে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে।


সরেজমিন কুড়িগ্রাম শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটর দুরে রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের সিংহীমারী গ্রামের মেঠোপথ ধরে যেতেই কানে বাজে শিশুদের সমবেত কন্ঠ। এক সাথে গাইছে-‘সময় গেলে সাধন হবে না…’ গানের সুর ধরে এগুতেই চোখে পরে ‘সেবালয় গুরুগৃহ’-এর ছোট্ট সাইনবোর্ড। জীর্ণ টিন সেড ঘরের মেঝেতে প্রায় সত্তর/আশি জন শিশু এক সাথে গলা ছেড়ে গাইছে। হারমনিয়াম বাজিয়ে গানের তালিম দিচ্ছেন একজন গুরু অপর আর একজন গুরু তবলা বাজিয়ে সহযোগিতা করছেন। দুই শিশু গানের সাথে বাজাচ্ছিল দোতরা, একতারা বাশি ও মন্দিরাও বাজাছ্ছিল শিশু শিক্ষার্থীরাই। গান শুনে মোহমুগ্ধ হয়ে যায় সকলেই।

সেখানে কথা হয়, শিক্ষার্থী স্নেহা, বৃষ্টি, সুলভ, নয়নের সাথে, তারা জানায়, এখানে তারা লালন, পল্লীগীতি, মুর্শিদী, ভাওয়াইয়াসহ বিভিন্ন বাউল গান শেখে। এছাড়াও এই গুরুগৃহে বাদ্য যন্ত্র বাজানোও শেখে তারা।

গুরু নারায়ন চন্দ্র রায় জানান, গুরুগৃহে শিক্ষার্থীদের বিনে পয়সায় সপ্তাহের দুইদিন শুক্রবার ও শনিবার নিয়মিত শেখানো হয় লোক গান ও লোক বাদ্যযন্ত্র। গ্রামের সেইসব শিশুরা এখানে গান শেখে যারা একেবারে প্রান্তিক পরিবারের সন্তান। এরা কখনও শহরে গিয়ে গানের স্কুলে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গান শেখা বা সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ পেত নাআমরা চেষ্টা করছি সেইসব শিশুদের লোক গান ও লোক বাদ্যযন্ত্রে তালিম দেয়ার।

মায়ের তরীর পরিচালক সুজন কুমার বেদ জানান, নরওয়ের নাগরিক কবি, আলোকচিত্রী ও গবেষক উয়েরা সেথের বাংলা ও বাঙালী লোক সংস্কৃতি চর্চাকে বাচিয়ে রাখতে আমাদের মতন সাংস্কৃতিককর্মীদের সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সাংস্কৃতিক ও মানবিক সংগঠন ‘মায়ের তরী’। এখানে প্রায় ৬শতাধিক শিশু লোক সংগীত ও লোক বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখছে। সেই সাথে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি। আমরা মনে করি, মায়ের তরী শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়একটি দর্শন, একটি আন্দোলন।

জানা গেছে, মায়ের তরীর মূল কার্যলয় লালমনিরহাট উপজেলার আদিতমারীর দেওডোবা গ্রামে। এই সংগঠনের মাধ্যমে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় চালু হয়েছে ৯টি ‘গুরুগৃহ, যেখানে ৪৬০জন শিশু শেখছে বাংলা লোকগান, এবং দুটি লোকবাদ্যযন্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১২৫ শিক্ষার্থী শেখছে লোক বাদ্যযন্ত্র। সেই সাথে একটি তরীর ক্লাস পরিচালিত হয় যেখানে ১৫ শিক্ষার্থী প্রতিমাসে দিনব্যাপী বিশেষ ক্লাসে লোকসংগীত এর বিভিন্ন ধারা সম্বন্ধে বিশেষ ধারণা গ্রহণ করে

এখানে প্রত্যেকটি গুরুগৃহের গুরুরা নিজনিজ গৃহে শিক্ষাদান করেন। বিনা অর্থে শিশুরা তবলার ছন্দে, দোতারা বা একতারা বাজিয়ে শিখছে লালন, বাউল, মুর্শিদী, মারফতি, ভাওয়াইয়া আর পল্লীগানের সুর। শিখছে বেহালা, একতারা, দোতারা, বাঁশি, তবলা, খমোক, সারিন্দাসহ লুপ্ত প্রায় লোক বাদ্যযন্ত্র।

মায়ের তরীর অন্যতম সংগঠক ইউসুফ আলমগীর জানান,‘লোক সংগীত চর্চার মাধ্যমে শিশুদের আত্মসুদ্ধি ও জীবন বৃদ্ধি’-এই চিন্তাকে ধারণ করে মায়ের তরী গ্রামীণ বাংলার প্রায় হারিয়ে যাওয়া সুর ও শব্দকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজ করছে। এখন এই অঞ্চলে মায়ের তরীর গুরুগৃহগুলো হয়ে উঠেছে বিভিন্ন ধারার লোকগান চর্চার আতুর ঘর।

মায়ের তরীর প্রতিষ্ঠাতা নরওয়ের নাগরিক কবি, আলোকচিত্রী ও গবেষক মায়ের তরীর প্রতিষ্ঠাতা নরওয়ের নাগরিক কবি, আলোকচিত্রী ও গবেষক উয়েরা সেথের বলেন, বর্তমান পৃথিবীর যেমন অবস্থা-যুদ্ধ এবং প্রকৃতির বিপর্যয় তাতে করে এই সমাজকে সুস্থ্য রাখা খুবই কঠিন। সেখানে আমার মনে হয়েছে লালন, বাউল, মারফতি, মুর্শিদীসহ লোক সংগীত সেই অস্থিরতা থেকে মানুষকে স্থির করতে পারে। মানুষকে মানবিক আর প্রকৃতি প্রেমী করতে পারে। আর সে কারণেই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সংস্কৃতিককর্মীদের নিয়ে আমি যাত্রা করছি। আর সমাজের ছোট্ট একটি অংশ ‘মায়ের তরী’। খুব চেষ্টা করছি এই বয়সের শিশুদের লোক সংগীত শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার।

উল্লেখ্য নরওয়ের নাগরিক কবি ও গবেষক উয়েরা সেথের প্রথম বাংলাদেশ আসেন ১৯৯৮ সালে। সে সময় তিনি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার উত্তর নামাজের চর এলাকায় বন্যা পরবর্তী মানুষের জীবন দেখতে যান। সেখানে চরের মহিলাদের কন্ঠে মারফতি ও মুর্শিদী গান শুনে সেই সুরের প্রেমে পড়েন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে মারফতি, মুর্শিদী, ভাওয়াইয়া, লালননহ নানা লোকগানে তিনি সমৃদ্ধ হন। পরে স্থানীয় লোক শিল্পী-সংগঠকদের সাথে নিয়ে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন মায়ের তরী। সেই সাথে ৫৩টি লালন গান নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনুবাদ করে একটি বই প্রকাশ করা হয়েছে।

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন