
প্রিন্ট: ২৮ মার্চ ২০২৫, ০২:১০ এএম
এনআরবিসি ব্যাংকে অনিয়ম ও দুর্নীতি

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

ছবি : সংগৃহীত
অনিয়ম জালিয়াতির স্বর্গরাজ্য এনআরবিসি ব্যাংক। একের পর এক অপরাধ করে তা লুকিয়ে রেখেছে ব্যাংকটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। অনিয়ম আড়াল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দীর্ঘদিন ধরে বিভ্রান্ত করে আসছিল দুর্নীতিবাজ চক্রটি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গোপন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অপরাধের দায়ে ব্যাংকটিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একইসঙ্গে, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময়সীমা বেধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক সুত্রে জানা যায়, ব্যাংকটির আলোচিত চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের ইশারায় এসব অপকর্ম চালিয়ে আসছে তারই তৈরি বিশেষ গ্যাং। বিগত সরকারের প্রভাবশালীদের বলয়ে শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে তমাল। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং তার অনুসারী কয়েকজন চিহ্নিত অপরাধীর সমন্নয়ে বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে কর্মকর্তা ও অংশীজনদের জিম্মি করে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া হতো। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ভগ্নিপতি সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে কোন প্রকার অভিজ্ঞতা ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে অনিয়মের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। আরেক সাবেক গভর্নর ফজলে কবীরকে নানা সুবিধা দিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিল তমালচক্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক তদন্ত এবং একাধিক নথিপত্র পর্যালোচনা করে এসব তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। বোর্ড সভায় অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ এবং বিপুল অর্থ অপচয়ের প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে।
সম্প্রতি এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর প্রেরিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপনীয় একটি প্রতিবেদন হাতে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যাংকের ও আর নিজাম রোড শাখার হিসাবধারী মো. রেজাউল বশির চৌধুরীর সঞ্চয়ী হিসাবে দীর্ঘ সময় ধরে সন্দেহজনক লেনদেন চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও তা বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট না করে গোপন করা হয়েছে। অথচ আইন অনুযায়ী এসব তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ইউনিটকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই অপারেধের জন্য ব্যাংকটিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার অর্থ ৭ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় চলতি হিসাব থেকে জরিমানার অর্থ আদায় করা হবে।
এসব অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ১৮মে থেকে ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল সময়ে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় দায়িত্ব পালনকারী শাখা ব্যবস্থাপক, শাখা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা, ব্যাংকের প্রধান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা এবং মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সংঘটিত লেনদেনের সঙ্গে জড়িত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়-দায়িত্ব নিরুপণ করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। শাস্তি নিশ্চিতে ৩০ দিনের সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকটির গোপনীয় আরও তথ্য খুজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। উদ্দেশ্যমূলকভাবে উদ্যোক্তা পরিচালক আবু বকর চৌধুরীর জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গোপন করা হয়, যা ব্যাংকের অপরাপর নথি বিশ্লেষণে ধরা পরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করার অপরাধে ব্যাংকের পরিচালক আবু বকর চৌধুরীসহ সকল পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এবং কোম্পানী সেক্রেটারীসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সে বিষয়ে ১৪ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তাছাড়া উদ্যোক্তাদের শেয়ারের তথ্য নিয়েও মিথ্যচার করেছে এনআরবিসি ব্যাংক। ব্যাংকটির ঘোষণা অনুযায়ী বর্তমানে এনআরবিসি ব্যাংক পিএলসির ৬৮.০৬ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তা/পরিচালক এবং ৩১.৯৪ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ধারণ করছেন। যা পরিদর্শন দলের কাছে মিথ্যা হিসেবে ধরা পড়েছে। তাই ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সে বিষয়ে ১৪ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সঠিক তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি ৬ মাসের মধ্যে ব্যাংকটির অনিবাসী উদ্যোক্তাদের ধারণকৃত শেয়ারের শতকরা হার অনধিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ হলে ব্যাংক কোম্পানী আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাকের নিরীক্ষায় দেখা যায়, ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনায় যথাযথ শর্ত পালনে ব্যর্থ হয়েছে এনআরবিসি ব্যাংক। ব্যর্থতার কারণে অদক্ষতা ও দায়িত্বে অবহেলার দায়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ১ মাসের মধ্যে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার প্রমাণপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংকটি অনিয়ম করে তা লুকিয়ে রেখেছিল। আমাদের কর্মকর্তারা তা খুঁজে বের করেছে। অপরাধের জন্য ব্যাংকটিকে জরিমানা করা হয়েছে। একই সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তিরে আওতায় আনতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
এসব বিষয়ে জানতে এনআরবিসি ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক রবিউল ইসলামকে গতকাল সন্ধ্যায় কল করা হলে তার মোবইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের নম্বরও বন্ধ রয়েছে। ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ ছেড়েছেন আলোচিত এই চেয়ারম্যান। তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা রয়েছে। জুলাই বিপ্লব দমনে পৃষ্ঠপোশকতার অভিযোগে তাকে আসামী করা হয়েছে।