ঘুষ, তদবির আর সিন্ডিকেটের জালে নিয়ন্ত্রণহীন পেঁয়াজের বাজার
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০০ পিএম
বাজারে এখন পেঁয়াজ নয়, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পেঁয়াজের আমদানি অনুমতিপত্র আইপি। অফিসঘরের পিছনের দরজায় নীরব দরকষাকষি, একেকটি আইপি বিক্রি হচ্ছে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত। তদবির আর ঘুষ দিয়ে যারা আইপি তুলছেন, তাদের অনেকেই প্রকৃত ব্যবসায়ী নন; তারা আইপি নিয়ে তা ব্যবসায়ীদের হাতে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলাফল, ভারত থেকে পেঁয়াজ আসার পরও দেশের বাজারে দাম কমার বদলে চাপ বেড়েছে আরও।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারক শরীফুল ইসলাম বলেন, সরকার সাধারণ মানুষের কথা ভেবে আমদানির অনুমতি দিলেও প্রতিদিন মাত্র ৫০টি আইপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাজারকে আরও চড়া করে দিয়েছে। তার ভাষায়, ৪২ টাকায় কেনা পেঁয়াজ সীমান্তেই ১০৫–১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনটি আবেদন করেও একটি আইপিও পাইনি। তদবির ছাড়া কারও কিছু হচ্ছে না।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আইপি বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিক্রি হওয়ায় আমদানির খরচ কৃত্রিমভাবে বেড়ে যাচ্ছে। কেউ ৪ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে আইপি নিয়ে ৮ লাখে বিক্রি করছেন। ফলে আমদানির লক্ষ্য জনস্বস্তি নয়, তৈরি হচ্ছে সুযোগসন্ধানী বাজার।
এদিকে খতিয়ে দেখা গেছে, ভারতীয় পেঁয়াজ এনে কেজিপ্রতি মোট খরচ পড়ে প্রায় ৪২ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু সীমান্তেই কেজি ১০৫–১১০ টাকায় বেচা হচ্ছে। হিসাব বলছে, একজন আমদানিকারক ৩০ টনের এক চালানে ১৯ লাখ টাকার বেশি লাভ করছেন। খাতুনগঞ্জে গেলে আবার দাম আরও ওপরে ওঠে; সেখানে পাইকাররা শুধুই কমিশনভিত্তিক ব্যবসা করেন। কাগজপত্রহীন এই লেনদেন যেন ভাসমান বাজার, যার কোনো দায় কোনো পক্ষই নিচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আমদানিকারক বলেন, সীমিতসংখ্যক আইপি সরবরাহ করে সরকারই মূলত অতি মুনাফার পথ খুলে দিয়েছে। অন্যদিকে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কম, মুড়িকাটা এখনো পুরোপুরি আসেনি। ফলে বাজারের ওপর চাপ বাড়ছেই।
ভোক্তা অধিদপ্তর খাতুনগঞ্জে একদিন অভিযান চালিয়ে দুজনকে জরিমানা করলেও বাজারে তাতে কোনো প্রভাব পড়েনি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ৪২ টাকার পেঁয়াজ ১১৭ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। বিক্রেতারা কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী নেতা মো. ইদ্রিস বলেন, সরবরাহ কম, গুদাম ফাঁকা। তিনি বলেন, ব্যাপক হারে আমদানির অনুমতি দিলে বাজার স্বাভাবিক হবে।
ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন জানান, পেঁয়াজে কেজিপ্রতি ৬০ টাকার বেশি লাভ হচ্ছে, যা অস্বাভাবিক এবং বাজার অস্থিরতার মূল কারণ।
রাজধানীতে পেঁয়াজের আগুন
খুচরা বাজারে আমদানির পেঁয়াজ ১৪০ টাকা, দেশি পুরোনো ১৪০–১৫০ টাকা, নতুন মুড়িকাটা ১১০–১২৫ টাকা। পাইকাররা বলছেন, দাম বেশি বলে কম দামে বিক্রি সম্ভব নয়।
বাজার করতে আসা ক্রেতাদের অভিযোগ, “আমদানির পরও দাম কমে না। বাজার সিন্ডিকেটের কবজায়।”
শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারে পাইকাররা জানান, বস্তায় কয়েক কেজি পচা থাকায় খরচ বেড়ে যায়। আর সরকার প্রতিদিন মাত্র দেড় হাজার টন আমদানির অনুমতি দিচ্ছে, যা বাজার ঠাণ্ডা করার জন্য যথেষ্ট নয়।
শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী নেতা মো. মাজেদ বলেন, বেশি আমদানি হলে দাম ৫০–৬০ টাকায় নামতে পারে। আরও ১০–১৫ দিন সময় লাগবে।
সব মিলিয়ে, পেঁয়াজকে ঘিরে বাজার এখন চোখ বুজে ছুটে চলা দৌড়ে পরিণত—যেখানে দৌড়াচ্ছে সিন্ডিকেট, আর হাঁপাচ্ছে ভোক্তা।



