চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফায়। জুলাই–সেপ্টেম্বর মেয়াদে সোমবার পর্যন্ত ১১০টি কোম্পানি আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৫৪টির—অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকের—শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) কমেছে। সংখ্যাটি দেখায় বাজার চাহিদা হ্রাস, ব্যয় বৃদ্ধি এবং মুনাফায় চাপ স্পষ্ট।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৫১টি কোম্পানির ইপিএস বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ হারে, আর ৫টির আয়-ব্যয় অপরিবর্তিত। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়—ইপিএস বাড়া বা কমা সত্ত্বেও ৩১টি কোম্পানি এখনো লোকসানে। অর্থাৎ ব্যবসার খরচ বাড়ছে, বিক্রি কমছে, আর মুনাফায় ফিরতে সময় লাগবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ব্যবসায় প্রবৃদ্ধির ধীরগতি, পরিচালন ব্যয় বাড়া এবং ঋণ–কর চাপই মুনাফা কমার প্রধান কারণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য আল-আমিন বলেন, উৎপাদন ব্যয়, কাঁচামাল আমদানির খরচ, ডলারের দাম, প্রযুক্তি খাতের চার্জ এবং ব্যাংক সুদের হার সবই বেড়েছে। ফলে নিট মুনাফা মার্জিন সংকুচিত।
জেএমআই হসপিটাল জানিয়েছে, বিক্রি কমলেও পরিচালন ব্যয় কমেনি; এতে মুনাফায় চাপ বেড়েছে।
যেসব কোম্পানির লোকসান বেড়েছে
১৩টি লোকসানি কোম্পানির ক্ষতি আরও বেড়েছে। সবচেয়ে বড় আঘাত এসকোয়ার নিটে—ঋণাত্মক ৭ পয়সা থেকে ইপিএস নেমে হয়েছে ঋণাত্মক ১ টাকা ১০ পয়সা, লোকসান বেড়েছে ১ হাজার ৪৭১ শতাংশ।
মেঘনা সিমেন্টও বড় ধাক্কায়—লোকসান বেড়েছে ৫৪৪ শতাংশ, ইপিএস দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২১ টাকা ১৯ পয়সায়; তালিকার সবচেয়ে বড় লোকসান।
বিবিএস কেব্লসের লোকসান বেড়েছে ৩৩০ শতাংশ, বসুন্ধরা পেপারের ২৬৬ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত আইসিবির লোকসান বেড়েছে প্রায় ১০৩ শতাংশ।
লোকসান কমেছে যাদের
সাফকো স্পিনিং, জিকিউ বলপেন, অলিম্পিক অ্যাকসেসরিজ, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস, সি পার্ল, ডেলটা স্পিনার্স ও পেনিনসুলা চিটাগং—মোট ৭টি কোম্পানির লোকসান কিছুটা কমলেও তারা এখনো মুনাফায় ফিরতে পারেনি।
যাদের মুনাফা বেড়েছে
৫১টি কোম্পানি আগের বছরের তুলনায় ভালো মুনাফা করেছে।
এভিন্স টেক্সটাইল সবচেয়ে বড় লাফ—ইপিএস ১ পয়সা থেকে ১১ পয়সা (১,০০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি)।
বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লোকসান কাটিয়ে ৬৬ পয়সা মুনাফায়—প্রবৃদ্ধি ৬০৭ শতাংশ।
খুলনা পাওয়ারের ইপিএস বেড়েছে ৫২৫ শতাংশ, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার ৫০০ শতাংশ, রহিম টেক্সটাইল ৪৮২ শতাংশ।
যাদের মুনাফা কমেছে
৫৪টি কোম্পানির মুনাফা কমেছে।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় বিডি থাই ফুড—৩ পয়সা মুনাফা থেকে এবার ৪৯ পয়সা লোকসান, লোকসান বেড়েছে ১,৭৩৩ শতাংশ।
ন্যাশনাল টিউবসের লোকসান বেড়েছে ৭৪১ শতাংশ।
মেঘনা সিমেন্ট টাকার হিসাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত—ইপিএস কমেছে এক লাফে ২৪ টাকা ৪৮ পয়সা।
শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজের মুনাফা কমেছে ৪৩৫ শতাংশ এবং ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডাইংয়ের ৩৩৯ শতাংশ।
আস্থা ফেরাতে যা জরুরি
বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা বাড়ানো জরুরি।
ট্রেজার সিকিউরিটিজের মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ বলেন, খরচ নিয়ন্ত্রণে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। মুদ্রা স্থিতিশীলতা এবং সুদের হার কমাতে পারলে ব্যবসা স্বাভাবিক হতে পারে।
অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি মনে করেন, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের চাপ বজায় থাকলে আগামী প্রান্তিকেও একই চিত্র দেখা দিতে পারে। বর্তমান বাস্তবতায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।



