মার্জারের জটিলতায় গ্রাহকের টাকা আটকে, গভীর সংকটে পাঁচ ইসলামিক ব্যাংক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৩৭ এএম
আইসিইউতে থাকা রোগীর চিকিৎসা, বিদেশে পড়াশোনার খরচ কিংবা মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো টাকাও তুলতে পারছেন না একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ইসলামিক ব্যাংকের গ্রাহকরা। মার্জারের ঘোষণা দেওয়ার পর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় এসব ব্যাংক এখন ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। নতুন আমানত আসছে না, বাংলাদেশ ব্যাংকও আপাতত সহায়তা দিচ্ছে না—সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলো কার্যত অচল অবস্থায় রয়েছে।
গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রয়োজনে ব্যাংক যদি জমানো টাকা না দেয়, তাহলে মানুষ কেন সেখানে আমানত রাখবে? এই অভিযোগে প্রতিদিনই ব্যাংক শাখাগুলোতে গ্রাহক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণামতে, একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংক হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। নতুন ব্যাংকের সম্ভাব্য নাম নির্ধারিত হয়েছে ‘ইউনাইটেড ইসলামিক ব্যাংক’ বা ‘সম্মিলিত ইসলামিক ব্যাংক’। তবে মার্জারের অগ্রগতি না থাকায় গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তীব্র অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন ধরেই তারল্য সংকটে ভুগছে। একীভূতকরণের ঘোষণার পর থেকে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এই দুর্ভোগ ব্যাংকগুলোর দীর্ঘদিনের দুরবস্থার ফল। এখন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এগুলো মার্জারের প্রক্রিয়ায় আছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত তহবিল দেবে না—এটাই স্বাভাবিক। মার্জারের পর নতুন ব্যাংকে তহবিল সরবরাহ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার চেষ্টা করছে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে আমানতকারীদের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু এই অবস্থায় গ্রাহকদের দুর্ভোগ অত্যন্ত দুঃখজনক।
এক গ্রাহক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমার বাবা আইসিইউতে ভর্তি। পেনশনের সব টাকা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে রেখেছিলেন। এখন টাকার অভাবে চিকিৎসা চালাতে পারছি না। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেছে, কিন্তু কবে হবে তা কেউ জানে না।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক সংকট এতটাই তীব্র যে, কর্মীদের বেতনও এখন আমানতকারীদের টাকা থেকে দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বলেন, এই ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট ভয়াবহ। আমরা তাদের ৪০ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছি, কিন্তু কাজ হয়নি। তাই এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে—পাঁচটি ব্যাংক একত্র করে রি-ক্যাপিটালাইজ করা হবে। প্রথমে এটি সরকারি ব্যাংক হিসেবে চালু করা হবে, পরে ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হবে।
তিনি আরও জানান, জনবল পুনর্বিন্যাস, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, নতুন গ্রাহক আনা ও প্রযুক্তি উন্নয়ন—এসব হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, এখন আদায় হচ্ছে না, নতুন আমানতও আসছে না। এ অবস্থায় গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এটি কর্মকর্তাদের জন্যও কষ্টদায়ক বাস্তবতা।
মার্জার প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও সময় লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্স ইস্যু করার পর নতুন ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হতে এক-দুই মাস লাগতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রেজিস্ট্রি সম্পন্ন ও প্রশাসক নিয়োগের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে প্রায় ১৫ দিন সময় লাগতে পারে। প্রাথমিকভাবে ব্যাংকগুলোকে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি সহায়তা দেওয়া হবে, যা আসবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আমানত বিমা তহবিল থেকে।
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পাঁচ ব্যাংককে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিলেও তাতে কোনো সুফল মেলেনি। নতুন কোনো তহবিল বা আমানত না আসায় ব্যাংকগুলো এখন চরম তারল্য সংকটে নিমজ্জিত। ফলে গ্রাহকরা যেমন টাকার জন্য হতাশ, কর্মকর্তারাও রয়েছেন অজানা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায়।



