ব্যাংকিং খাতের আর্থিক ভারসাম্য ফেরাতে বিবির ভূমিকা
শামসুল আলম সেতু
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০৭ পিএম
খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান চাপ কমাতে এবং ব্যাংকিং খাতের আর্থিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে মন্দ শ্রেণির ঋণ অবলোপনে কিছুটা শিথিলতা এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি)। একই সঙ্গে অবলোপনের কমপক্ষে ৩০ কর্মদিবস আগে সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতাকে নোটিশ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা যুক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে মন্দ ঋণ অবলোপনে সময়সীমা শিথিল, বিশ্লেষকদের আশঙ্কা—‘কাগুজে স্বস্তি, বাস্তব ঝুঁকি রয়ে গেল’।
নতুন নির্দেশনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো ঋণগ্রহীতাকে লিখিতভাবে অবহিত করা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কোনো ঋণ অবলোপনের পরও যদি ঋণগ্রহীতা সম্পূর্ণ দায় পরিশোধ না করেন, তবে তিনি খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবেই চিহ্নিত থাকবেন। তাই অবলোপনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নোটিশ পাঠিয়ে বিষয়টি নিশ্চিতভাবে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপে ব্যাংকগুলোর হিসাব বই কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে। তবে প্রকৃত আর্থিক ঝুঁকি কমানোর বদলে এটি অনেক সময় কাগুজে স্বচ্ছতা আনে—যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধান নয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, খেলাপি ঋণের চাপ সামাল দিতে এবং ব্যাংক খাতের হিসাব খানিকটা হালকা করতে মন্দ শ্রেণির ঋণ অবলোপনে সময়সীমা শিথিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন থেকে অবলোপনের আগে সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতাকে নোটিশ প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ফেব্রুয়ারির পুরোনো নীতিমালা সংশোধন করে যে নতুন নির্দেশনা জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ-এমন মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত ঋণ হিসাব অবলোপনযোগ্য হবে। তবে পুরোনো খেলাপি ঋণগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে অবলোপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, অবলোপনের পরও ঋণগ্রহীতা যদি ঋণ পরিশোধ না করেন, তবে তিনি খেলাপি হিসেবেই চিহ্নিত থাকবেন। তাই অবলোপনের সিদ্ধান্তের আগে নোটিশ পাঠানো ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই বিধানকে ব্যাংক বিশেষজ্ঞরা দেখছেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে। তাদের মতে, এটি ঋণগ্রহীতাকে সময়মতো দায় পরিশোধে অনুপ্রাণিত করতে পারে, যদিও বাস্তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে ব্যাংকের বাস্তবায়ন সক্ষমতার ওপর।
জানা গেছে, সংশোধিত নীতিমালায় পুরোনো অনেক বিধান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—কোনো মৃত ব্যক্তির নিজ নামে বা একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত ঋণ ব্যাংক নিজ বিবেচনায় অবলোপন করতে পারবে;
অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নগদ প্রণোদনা দেওয়া যাবে;
প্রণোদনা নীতি প্রণয়নে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে।
এ ছাড়া বিদ্যমান পাঁচটি অবলোপন পদ্ধতি আগের মতোই বহাল আছে—
বন্ধকিকৃত সম্পত্তি বিক্রয়ের চেষ্টা ব্যর্থ হলে ঋণ অবলোপনযোগ্য হবে, মামলা দায়েরের বাধ্যবাধকতা থাকবে (৫ লাখ টাকার নিচে ব্যতিক্রম), পূর্ণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে, কোনো ঋণ আংশিকভাবে অবলোপন করা যাবে না এবং পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া অবলোপন সম্ভব নয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পদক্ষেপ ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিটে সাময়িক স্বস্তি আনবে, কিন্তু মূল সমস্যা—অদক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাব ও পুনরুদ্ধার ব্যর্থতা—অবসান ঘটাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হাসান বলেন, অবলোপন মানে ঋণ মওকুফ নয়। এটি কেবল হিসাবের ভার লাঘবের একটি উপায়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে যদি আদায়ের সক্ষমতা না বাড়ানো যায়, তবে এটি কাগুজে স্বস্তি ছাড়া আর কিছু নয়।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাবেক নির্বাহী পরিচালক মনে করেন,অনেক ব্যাংক আগের বছরগুলোতে কৃত্রিমভাবে ক্ষতির পরিমাণ কম দেখানোর জন্য অবলোপন করেছে। এবার নতুন সময়সীমা ও নোটিশ বাধ্যবাধকতা থাকায় কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের প্রায় ৯ দশমিক ২ শতাংশ এখন খেলাপি। এর মধ্যে বড় একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে ‘মন্দ’ বা ‘ক্ষতিজনক’ শ্রেণিতে পড়ে আছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই প্রেক্ষাপটে অবলোপনের শিথিলতা ব্যাংকগুলোর কাগুজে কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করলেও, দেশের আর্থিক খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ আরও গভীর হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালা ব্যাংকগুলোর জন্য কিছুটা স্বস্তির বার্তা বয়ে আনলেও, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—এটি কেবল হিসাবগত ভারসাম্য আনবে, কাঠামোগত দুর্বলতা নয়।
তাদের ভাষায়,অবলোপন নয়, প্রয়োজন দক্ষ ঋণ পুনরুদ্ধার ও দায়বদ্ধ ব্যাংক ব্যবস্থাপনা।
উল্লেখ্য, বিদ্যমান নিয়মে ঋণ হিসাব অবলোপনে পাঁচটি পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-অবলোপনযোগ্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের অনুকূলে বন্ধকিকৃত সম্পত্তি (যদি থাকে) নিয়মানুগভাবে বিক্রয়ের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলে এবং ব্যাংকে নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের (গ্যারান্টার) নিকট থেকে পাওনা অর্থ আদায়ে সমর্থ না হলে ঐ ঋণ অবলোপনের আওতায় আসবে।
অবলোপনের জন্য নির্বাচিত ঋণ হিসাবগুলোর ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে কোনো আইনগত ব্যবস্থা গৃহীত না হয়ে থাকলে অবলোপনের পূর্বে অবশ্যই 'অর্থ ঋণ আদালত আইন ২০০৩' অনুযায়ী মামলা দায়ের করতে হবে। তবে এ আইনের আওতায় অত্যাবশ্যকীয়ভাবে মামলাযোগ্য না হলে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ এবং মৃত ব্যক্তির নিজ নামে কিংবা তার একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত যে কোনো অঙ্কের ঋণ মামলা দায়ের ছাড়া অবলোপন করা যাবে।
অবলোপনের পূর্বে সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবের স্থিতি থেকে শুধু রক্ষিত স্থগিত সুদ বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট ঋণস্থিতির সমপরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। চিহ্নিত প্রতিটি ঋণ হিসাবের বিপরীতে রক্ষিত প্রভিশন পর্যাপ্ত না হলে ব্যাংকের চলতি বছরের আয় খাত বিকলন করে অবশিষ্ট প্রভিশন সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে; কোনো ঋণ হিসাব আংশিকভাবে অবলোপন করা যাবে না; এবং ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া কোনো ঋণ হিসাব অবলোপন করা যাবে না।



