দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এখন বন্ড মার্কেটের হাতে তুলে দিচ্ছে সরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২৮ পিএম
দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা সীমিত করে বিকল্প পথ তৈরি করতে যাচ্ছে সরকার। আগামী বছর থেকেই ব্যাংকের পরিবর্তে বন্ড মার্কেটের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন চালু করা হবে। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই কমিটি বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, গ্রাহক সুরক্ষা এবং নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বন্ড মার্কেট থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রথা। বাংলাদেশও সেই চর্চা শুরু করতে যাচ্ছে। গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই কমিটি বন্ড মার্কেট উন্নয়ন, চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছে। গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বিদেশ থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত সুপারিশ তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সব প্রক্রিয়া শেষ হলে আগামী জুনের মধ্যে নতুন এই পদ্ধতি চালু করা হতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বড় প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ওপর নির্ভর না করে পুঁজিবাজারে যেতে হবে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প ভবিষ্যতে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমেই করা সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ক্যাপিটাল মার্কেট এখনো উন্নত নয়। সরকারি বন্ড থাকলেও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। ফলে বড় প্রকল্পগুলো ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভর করছে, যা ঝুঁকি ও ঋণখেলাপির কারণ হচ্ছে।
এদিকে, গত ১১ মে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ‘Bond Market Development in Bangladesh: Challenges and Recommendations’ শীর্ষক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বন্ড মার্কেটের প্রতিবন্ধকতা, নীতিগত ঘাটতি ও কর কাঠামোর জটিলতা চিহ্নিত করা হয়েছে।
পরবর্তী ধাপে আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় সেমিনার আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিএসইসি, আইডিআরএ, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নেবে।
বন্ড মার্কেট উন্নয়ন কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, দেশের বড় কোম্পানিগুলোকে ব্যাংকঋণের পরিবর্তে বন্ড ও সিকিউরিটিজ ইস্যুর মাধ্যমে অর্থায়নে উৎসাহিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি কমবে এবং পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়বে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও মাসরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়া যায় না বললেই চলে। প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পায়নের জন্য বন্ড মার্কেট অপরিহার্য। এই বাজার যত দ্রুত প্রসারিত হবে, অর্থনীতির জন্য তত বেশি লাভজনক হবে।
বর্তমানে দেশে মাত্র ১৬টি করপোরেট বন্ড চালু রয়েছে, আর সুকুক বন্ড রয়েছে ২৩৩টি। সরকারি বন্ড এখনো সেকেন্ডারি মার্কেটে সক্রিয় নয়। সব মিলিয়ে দেশের স্টক মার্কেটে বন্ডের মোট মূল্য প্রায় ৬ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ইক্যুইটি ৩ লাখ ৩৮ হাজার কোটি এবং সিকিউরিটিজ ২ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা।
বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকার, ব্যাংক ও বিভিন্ন করপোরেশন। সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে নির্দিষ্ট সময় পরপর মুনাফা পাওয়া যায়। বন্ড কেনার জন্য নির্দিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন হয়, আর ন্যূনতম এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়।



