ক্যাশলেস লেনদেন বাড়াতে জোর বিবি গভর্নরের
শামসুল আলম সেতু :
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৫, ০৫:৪৯ পিএম
গত বছরের আগস্টের পর থেকে একটি ডলারও বিক্রি করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জোর দিয়ে কথাটি উচ্চারণ করলেন। গভর্নর বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিদেশি ব্যাংকগুলো থেকে এলসি আটকে দেওয়া হয়নি। বরং প্রয়োজনমত সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় সহায়ক থাকছে। টাকা ছাপানো, সংরক্ষণ, পরিবহন ও সারাদেশে বণ্টনে প্রতিবছর ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় বলে জানান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এ খরচ কমাতে তিনি নগদ অর্থের ব্যবহার হ্রাস এবং ক্যাশলেস লেনদেন বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন।
চলতি অর্থবছরে দেশের মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ড. আহসান এইচ মনসুর। গভর্নর জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে আর্থিক খাত রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকে। কোনো ধরণের হস্তক্ষেপ বা দুর্বৃত্তায়ন না ঘটে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দায়বদ্ধতা বাড়াতে সংশোধনী অর্ডারও প্রস্তুত হচ্ছে। এছাড়া, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ সংশোধনের মাধ্যমে ৫০ শতাংশ স্বাধীন পরিচালক নিয়োগের বিধান আনা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেই বিনিয়োগ বাড়বে। নির্বাচন সামনে থাকায় বড় বিনিয়োগকারী আসার সম্ভাবনা কম হলেও কিছু বিনিয়োগ পাইপলাইনে রয়েছে।’
ড. মনসুর জানান, আর্থিক খাতে কোনো সঙ্কট নেই। বাজারে তারল্য বৃদ্ধি পেলে শেয়ারবাজারও ঘুরে দাঁড়াবে। মূল্যস্ফীতি কমানোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘এনবিআর সংস্কারে ভেতরের ‘শত্রু’ দমন করা হয়েছে এবং দ্রুত সংস্কার বাস্তবায়ন জরুরি।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে কিউআর কোডভিত্তিক লেনদেন জনপ্রিয় করতে নীতিগত সহায়তা ও প্রযুক্তি অবকাঠামো গড়ে তুলছে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কিউআর কোড ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে, যাতে লেনদেন দ্রুত, নিরাপদ ও স্বচ্ছ হয় এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমে।
রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত 'অন্তর্বর্তী সরকারের ৩৬৫ দিন' শীর্ষক অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন তিনি। অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তফিজুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন সংস্থাটির পক্ষ থেকে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য স্মার্টফোনের গুরুত্ব তুলে ধরে গভর্নর বলেন, ৬-৭ হাজার টাকায় ভালো মানের স্মার্টফোন বাজারে আনতে পারলে প্রায় শতভাগ মানুষকে এ সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হবে। এ জন্য ইন্টারনেটের দামও কমাতে হবে এবং সেবার মান বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, 'আন্তর্জাতিক ব্যাংকারদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে ২০০-এর বেশি বিদেশি ব্যাংক লাইন অব ক্রেডিট বন্ধ করেছিলো। আমরা তাদের বললাম এখানেই থামেন। আর করবেন না। আমরা যদি উন্নতি করতে না পারি তাহলে করবেন। আমরা কখনো বকেয়া রাখিনি, রাখবও না।' ২.৫ বিলিয়ন ডলার বকেয়া জমেছিল, পরে আমরা কমিটমেন্ট নিয়েছিলাম ধীরে ধীরে পরিশোধের। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি ভালো হয়েছে। প্রত্যেকটি ব্যাংককে বলা হয়েছিল, যারই অবলিগেশন থাকবে, সেটা যে-ই হোক—এস আলম বা বেক্সিমকো—পেমেন্ট করে দিন। প্রত্যেক বিদেশি ব্যাংক এখন বাংলাদেশের জন্য আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে, কেউ কেউ লাইন অব ক্রেডিটও বাড়িয়েছে', যোগ করেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা জরুরি বলে মনে করেন গভর্নর। এনিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা বুঝেছিলাম মূল্যস্ফীতি যদি কমাতে হয় তাহলে বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে হবে। একটা পলিসি ছিলো একটা ডলারও বিক্রি করবো না। গত বছরের ১৪ আগষ্টের পর থেকে একটা ডলারও বিক্রি করা হয়নি।'
গভর্নর আরও বলেন, 'প্রথমে আমাদের কিছু নৈতিক চাপ দিতে হয়েছে। দুবাই ভিত্তিক এগ্রিগেটরদের বলা হয়েছে, যদি তারা আমাদের নির্ধারিত রেটে না আসে, তবে তাদের কাছ থেকে কোনো ডলার কেনা হবে না। আমাদের রেট ১২২ টাকা, এই রেটে বিক্রি করতেই হবে। তারা চাইলে ডলার ধরে রাখতে পারে, এতে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই, কারণ আমরা জানি তারা পাঁচ থেকে সাত দিনের বেশি ধরে রাখতে পারবে না।'
আবাসন খাত প্রসঙ্গে তিনি জানান, দেশে এখনও কয়েক মিলিয়ন নতুন আবাসনের প্রয়োজন আছে। নগরকেন্দ্রিক উন্নয়ন অনিবার্য, তাই সাশ্রয়ী আবাসন পরিকল্পনা নিতে হবে। ব্যাংকের মালিকানাধীন জমি ডেভেলপারদের সঙ্গে অংশীদারত্বে ব্যবহার করার বিষয়েও ভাবা হচ্ছে।
সংলাপে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতে কিছু সংস্কার এনেছে, যা রফতানি খাতকে ভালো রেখেছে এবং বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে সহায়তা করেছে। তবে বিদেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আহরণ না বাড়া উদ্বেগজনক।
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি ভালো হওয়ায় বিদেশি ব্যাংকগুলো আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে এবং কেউ কেউ লাইন অব ক্রেডিট বাড়িয়েও দিয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা জরুরি উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, ‘দুবাই ভিত্তিক এগ্রিগেটরদের বলা হয়েছে আমাদের কাছে ডলার বিক্রি করতে।



