বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পাল্টা শুল্ক’ শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটনে তৃতীয় দফার আলোচনার শেষ দিনে এবং ট্রাম্পের শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগ মুহূর্তে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছে বাণিজ্য চুক্তি করে। চুক্তিতে বাংলাদেশ কী কী সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। এটি নিশ্চিত, সে দেশ থেকে আমদানি ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। নতুন শুল্ক ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও প্রস্তুতির জন্য আগামী ৭ আগস্ট পর্যন্ত সময় নেওয়া হয়েছে।
প্রথমে ৩৭ শতাংশ এবং পরে ৩৫ শতাংশ ঘোষণা করে আলোচনার সুযোগ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। শুধু বাংলাদেশ নয়, সবার ক্ষেত্রে একই কৌশল নেন তিনি। আলোচনার মধ্যেই বাণিজ্য সচিব জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার অর্ডার দিয়েছে। অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় ৫ বছরে ৩৫ লাখ টন গম কেনার সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এর আগে বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয় এমন প্রায় ১০০ পণ্যে শুল্ক ছাড় দেয়।
নতুন শুল্কহারকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সাফল্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সরকার মনে করছে, কূটনৈতিক সাফল্যের কারণে বাড়তি শুল্ক কমানো সম্ভব হয়েছে। আর রপ্তানিকারকরা বলেছেন, বাড়তি ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা তাদের জন্য আপাতত স্বস্তির খবর। আবার প্রতিযোগীদের সঙ্গে সমান বা কাছাকাছি এবং কারও কারও চেয়ে কম শুল্ক বাংলাদেশের ওপর কার্যকর হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান তৈরি হয়েছে। তবে পণ্যভিত্তিক শুল্কের সঙ্গে বাড়তি ২০ শতাংশ যোগ হলে ৩৫ শতাংশ হবে। আগের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি শুল্কে আমদানির ফলে মার্কিন ক্রেতা এবং স্থানীয় ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমতে পারে। ফলে রপ্তানির ওপর চাপ আসতে পারে।
বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এখনও চীন ও ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলমান। তারা যদি বেশি সুবিধা পায় তা হলে তখন নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। এ ছাড়া বাড়তি শুল্কে ছাড় পেতে বাংলাদেশকে কী কী সুবিধা দিতে হয়েছে, তার পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাংলাদেশের কতটুকু লাভ হলো তা এখনই পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক হারের হ্রাস আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির জায়গা তৈরি করে না। এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা।
গত ২ এপ্রিল বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের নির্বাহী আদেশ জারি করেন ট্রাম্প। আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন ও জাতীয় নিরাপত্তা আইন এবং সংবিধানে দেওয়া প্রেসিডেন্টর ক্ষমতা বলে ট্রাম্প এ আদেশ জারি করেন। পাল্টা শুল্ক গত ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বিভিন্ন দেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কার্যকরের সময় ৯ জুলাই পর্যন্ত বাড়ান।
ট্রাম্পের উদ্দেশ্য ছিল– এ সময়ের মধ্যে বাণিজ্য অংশীদাররা তার প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে মার্কিন পণ্যের আমদানি বাড়ানো এবং শুল্ক কমানোর চুক্তি করুক। ৯ জুলাই ট্রাম্প সিদ্ধান্ত কার্যকরের মেয়াদ ১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ান এবং বাংলাদেশসহ ২১টি দেশের ওপর নতুন পাল্টা শুল্কের হার ঘোষণা করেন। বৃহস্পতিবার সংশোধিত নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প ৬৯টি দেশের (ইইউকে দেশ হিসেবে ধরে) ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন। ইইউর সদস্যদের আলাদা ধরলে এ সংখ্যা হবে ৯৫টি। যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পাল্টা শুল্ক ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশ গত এপ্রিল ও জুনে দুই দফা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে। তবে দুপক্ষের মধ্যে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। এর মধ্যে গত ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ না করতে একটি নন-ডিসক্লোজার চুক্তি হয়। এখন বাণিজ্য চুক্তি হওয়ার পর তা প্রকাশ করা যাবে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
যেসব ছাড়ের বিনিময়ে কমল শুল্ক
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৮৭০ কোটি ডলারের রপ্তানি করেছে। এর বিপরীতে ২৭০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ দেশটি থেকে আমদানি হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার। জানা গেছে, পাল্টা শুল্ক কমানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেড় বিলিয়ন বা ১৫০ কোটি ডলার আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।
ঘাটতি কমানোর অংশ হিসেবে আগামী কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কিনবে সরকার। এতে স্থানীয় মূল্যে খরচ হতে পারে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। তবে এসব উড়োজাহাজ কেনা হবে ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে। এ ছাড়া সম্প্রতি পাঁচ বছর মেয়াদে প্রতিবছর সাত লাখ টন করে গম আমদানি করতে এমওইউ করে বাংলাদেশ। এর আওতায় গত মাসে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। গত ২৩ জুলাই অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জনান, শুল্ক কমানোর দরকষাকষিতে সুবিধা পেতে কিছুটা বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম কেনা হচ্ছে।
জানা গেছে, এলএনজি, সামরিক সরঞ্জামসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ সহজ করা এবং শুল্ক ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিছু পণ্যে শূন্য শুল্ক ও কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেসরকারি খাত তুলা, সয়াবিন বীজ, ডাল ইত্যাদি পণ্য আমদানি বাড়াতে পারে, সে ব্যাপারে নীতি-সহায়তা দেবে সরকার।
অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জটিলতা তৈরি করবে– বাণিজ্যের বাইরের এমন শর্ত মানতে নারাজ ছিল ঢাকা। এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল, দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে– এমন কোনো চুক্তি করা হবে না। তবে দরকষাকষির শেষ পর্যন্ত এ অবস্থান কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। গতকাল এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দরকষাকষি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সরকারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চূড়ান্ত সমঝোতা হয়েছে এবং চুক্তি হয়েছে। পরে কিছু থাকলেও তা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের চুক্তি প্রতিবছর ‘রিভিউ’ করার সুযোগ থাকে।
বেসরকারি পর্যায়ে তুলা ও সয়াবিন আমদানির চুক্তি
ব্যবসায়ীদের একটি দল আলাদাভাবে যুক্তরাষ্ট্রে যায়। দলে ছিলেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, বিটিএমএর দুই পরিচালক মোশারফ হোসেন ও মাসুদ রানা, এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আমিরুল হক, তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলসের পরিচালক চৌধুরী মোহাম্মদ হানিফ শোয়েব, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রমুখ।
বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়োজিত প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা সামাজিক মাধ্যমে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল তাঁকে জানিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ১৩০ মিলিয়ন ডলারের তুলা আমদানিতে দেশটির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। একই সঙ্গে ৩০ থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলারের সয়াবিন আমদানির জন্যও বেসরকারি পর্যায়ে চুক্তি হয়েছে। তবে এ পণ্য এসব প্রতিষ্ঠান আনবে না অন্য প্রতিষ্ঠান, তা তিনি জানাননি।
সরকারের বক্তব্য
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিকে ঐতিহাসিক চুক্তি আখ্যা দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য। তিনি শুক্রবার এক অভিনন্দন বার্তায় বলেন, ‘শুল্ক হার ২০ শতাংশ করা হয়েছে, যা পূর্বে আরোপিত হারের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। এর মাধ্যমে আমাদের আলোচকরা অসাধারণ কৌশলগত দক্ষতা এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ও সেটাকে আরও এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অবিচল প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছেন।’
তিনি উল্লেখ করেন, আলোচনার মাধ্যমে অর্জিত এ চুক্তি আমাদের তুলনামূলক সুবিধা সংরক্ষণ করেছে। পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি এবং আমাদের মূল জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেছে। এই অর্জন কেবল বাংলাদেশের বৈশ্বিক অঙ্গনে ক্রমবর্ধমান শক্তিকে তুলে ধরে না, বরং এটি বৃহত্তর সম্ভাবনা, ত্বরান্বিত প্রবৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত করে।
এদিকে পাল্টা শুল্ক হার ২০ শতাংশে নেমে আসায় বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। প্রতিক্রিয়ায় উপদেষ্টা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এতেও আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে থাকব। ফলে মার্কিন বাজারে আমাদের রপ্তানিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে আমরা আশা করেছিলাম, এটি ২০ শতাংশের নিচে থাকবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্যমূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় বাণিজ্য উপদেষ্টা সমালোচকদের হতাশ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য, বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ হওয়ায় প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ বিষয়ে আমরা খারাপ অবস্থানে নেই। তবে এখনও চীন ও ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলমান। তারা যদি আমাদের চেয়ে বেশি সুবিধা পায়, তা হলে তখন নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ দরকষাকষি উভয় পক্ষের ছাড় দেওয়ার মধ্যমেই হয়। তবে এ সুবিধা পেতে শেষ পর্যন্ত আমরা কী দিয়েছি, সেটা বড় বিষয়। গোপন চুক্তির আওতায় চুক্তি হয়ে গেলে তা প্রকাশ করতে বাধা নেই। আশা করি, সরকারও চুক্তিতে কী রয়েছে, তা জনগণের কাছে তুলে ধরবে।



