ছবি-সংগৃহীত
বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের (আসল ও সুদ) কিছু পরিমাণ শোধ করেছে। যা ৪০৮ কোটি ৭ লাখ ডলার। পতিত সরকার বাজেট সহায়তার নামে স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিশোধযোগ্য অনেক ঋণ নিয়েছিল। সেই ঋণ পরিশোধে চাপ পড়েছে বর্তমানে। তাই সুদে-আসলে মিলে উল্লেখিত অর্থ পরিশোধ করতে হলো।
দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো এক অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ মিলিয়ে পরিশোধ করা হয়েছে ৪০০ কোটিরও বেশি মার্কিন ডলার। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে মোট ৪০৮ কোটি ৭ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২১ শতাংশ বেশি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, এর মধ্যে ২৫৯ কোটি ৫ লাখ ডলার ছিল ঋণের মূলধন এবং ১৪৯ কোটি ১ লাখ ডলার ছিল সুদ। আগের অর্থবছরে এসব খাতে পরিশোধের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২০২ কোটি এবং ১৩৪ কোটি ৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ মূলধন পরিশোধে ২৯ শতাংশ এবং সুদ পরিশোধে ১১ শতাংশের মতো বৃদ্ধি হয়েছে।
এই ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে গত এক দশকে নেওয়া বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প ও বাজেট সহায়তার ঋণগুলোর অনুগ্রহকাল শেষ হয়ে যাওয়া।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পের ঋণের কিস্তি আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যেই শুরু হবে। ফলে ভবিষ্যতে এই চাপ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের অতি উৎসাহে নেওয়া অনেক বড় প্রকল্পের পেছনে যথাযথ পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক লাভজনকতা যাচাই করা হয়নি। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, '২০১৬-১৭ সাল থেকে সরকার যেসব বড় প্রকল্পে ঋণ নিয়েছে, তার অনেকগুলোই বাজেট ফুলিয়ে তৈরি হয়েছে, বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়েই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশে রাজস্ব আদায় দুর্বল থাকায় বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে এবং গত সাত বছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।'
অর্থনৈতিক চাপ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে টান পড়ে। তখন বাজেট সহায়তার নামে স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিশোধযোগ্য অনেক ঋণ নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর শর্ত ছিল কঠিন এবং সুদের হার ছিল বেশি। এখন সেই ঋণগুলোর কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ায় অর্থনৈতিক চাপ বেড়েছে।'
এদিকে নতুন করে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেছে ধীরগতি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮৩২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের নতুন ঋণচুক্তি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় অনেক কম। একই সময়ে ঋণের অর্থছাড়ও কমে এসেছে, যা দাঁড়িয়েছে ৮৫৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারে। আগের বছর এ পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
দেশে ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন ও প্রশাসনিক স্থবিরতার কারণে কিছু প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার কাজ থেকে সরে গেছে, ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে
ধীরগতি দেখা গেছে। আবার সরকারের মাঝারিমেয়াদি ঋণ কৌশল অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পে নতুন ঋণ নেওয়া কমিয়ে আনা হয়েছে। তবে বাজেটের ঘাটতি পূরণে রেকর্ড পরিমাণ ৩৪০ কোটি ডলারের সহায়তা নেওয়া হয়েছে।
ঋণদাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যাংক সবচেয়ে বেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার পরিমাণ ২৮৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১০০ কোটি ডলার ছিল সরাসরি বাজেট সহায়তা। এরপর রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, যারা ২০০ কোটি ডলার এবং জাপান, যারা ১৮৯ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অর্থছাড়ের দিক থেকেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক শীর্ষে রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন সময় এসেছে ঋণ ব্যবস্থাপনার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের। ভবিষ্যতে যেন ঋণের বোঝা দেশের অর্থনীতি ও বাজেট ব্যবস্থাকে বিপর্যন্ত না করে, সেজন্য এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে। শুধু ঋণ নেওয়ার দিকে নজর না দিয়ে সেই ঋণ কতটুকু অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর এবং সময়মতো পরিশোধযোগ্য তা নিশ্চিত করাই হবে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।



