Logo
Logo
×

অর্থনীতি

প্রিমিয়ার ব্যাংকের টাকা ইকবাল পরিবার যেভাবে পকেটে ভরেছে

Icon

স্টাফ রিপোর্টার :

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৫, ০৬:৫৫ পিএম

প্রিমিয়ার ব্যাংকের টাকা ইকবাল পরিবার যেভাবে পকেটে ভরেছে

প্রিমিয়ার ব্যাংক প্রতিবছর অন্তত ৬০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আসছে অতিরিক্ত ভাড়া, ভুতুড়ে ফ্লোর, অগ্রিম ২২০ কোটি টাকা সবই ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং তার পরিবারের সদস্যদের পকেট গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে এসব অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন উঠে এসেছে

দেশের সংকটাপন্ন ব্যাংকিং খাত নিয়ে খবরের শিরোনামে যখন ভুয়া ঋণের দাপট, সেই মুহূর্তে আরও জটিল ও আপাতদৃষ্টিতে বৈধ এক কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে। অভিযোগ উঠেছে, এ কাজের মূল হোতা ব্যাংকটির দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচবিএম ইকবাল। ২০২১ সালে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের পর ব্যাংক থেকে ওই অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে

আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এইচ বি এম ইকবাল ১৯৯৯ সালে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি তিনি পদত্যাগ করেন। তার মেয়াদজুড়েই পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। এই কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বনানীতে অবস্থিত এইচবিএম ইকবালের মালিকানাধীন ইকবাল সেন্টার, যা প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ব্যাংকটি ধারাবাহিকভাবে বাজারের প্রচলিত ভাড়ার চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে আসছিল।

প্রতিবেদনের হিসাবমতে, বাজারমূল্য অনুযায়ী ভাড়া প্রতি বর্গফুট ১০০ টাকা হলে ব্যাংকটির বছরে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ৬১.৫৩ কোটি টাকা।

ব্যাংকটি ইকবাল টাওয়ারের দুটি অস্তিত্বহীন, অসম্পূর্ণ ও অব্যবহারযোগ্য ফ্লোরের (২০ ও ২১-তলা) জন্য ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৪২ মাসে প্রায় ২৭ কোটি টাকা ভাড়া পরিশোধ করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, এই দুই ফ্লোরে কেবল ছাদ রয়েছে। দেয়াল, বৈদ্যুতিক লাইন, স্যানিটারি ফিটিংস, টাইলসকোনো কাজই করা হয়নি। তবু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েছে এবং ভাড়া পরিশোধ করেছে।

অতিরিক্ত মাসিক ভাড়া পরিশোধের বাইরেও ব্যাংকটি ইকবালের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রিম ভাড়া বাবদ প্রায় ২২০ কোটি টাকা দিয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের তহবিল কার্যত সরাসরি ইকবালের ব্যক্তিগত প্রপার্টি ব্যবসায় চলে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের সেন্ট্রাল গোডাউনের জন্য ভাইস চেয়ারম্যান মঈন ইকবালের (এইচবিএম ইকবালের ছেলে) মালিকানাধীন তেজগাঁও শিল্প এলাকার ২৫ হাজার বর্গফুটের একটি টিনশেড ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এতে প্রতি বছর দিতে হচ্ছে ৩.৭৫ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, গুদামের মাত্র এক-চতুর্থাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে, অথচ বনানীর নিজস্ব জমিতে স্থাপনা তৈরি করে সহজেই কম খরচে নিজস্ব গোডাউন চালানো সম্ভব।

এছাড়া ব্যাংকটির সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের (পিবিএসএল) গুলশান শাখার জন্য এইচবিএম ইকবালের স্ত্রীর মালিকানাধীন প্রিমিয়ার স্কয়ারের ১০ হাজার ৪০০ বর্গফুট জায়গা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। পিবিএসএলকে ২৩০.২০ কোটি টাকা ঋণও দিয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। এর মধ্যে ১০৬.৫৮ কোটি টাকার কোনো তথ্য ব্যাংকের সিএল বিবরণীতে নেই। সুদও আরোপ করা হয়েছে অস্বাভাবিক কম, মাত্র ৫ শতাংশ হারে।

ব্যাংকের বার্ষিক মুনাফার ১ শতাংশ অথবা ১ কোটি টাকার বেশি অনুদান দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই ২০২৩ সালে ৩০ কোটি ও ২০২৪ সালে আরও ৫ কোটি টাকা ফাউন্ডেশনে অনুদান দেওয়া হয়েছে

এই অর্থ ইকবাল পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, যেমন রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, জেড রহমান প্রিমিয়ার ব্যাংক স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির নামে ব্যয় দেখানো হয়। এতে কার্যত আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো ব্যাংক তার পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে ভবন ভাড়া নিতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। ওই কর্মকর্তা বলেন, 'এইচবিএম ইকবাল আগের সরকারের সময় প্রভাবশালী ছিলেন। তার কারণে অনেক কিছুই বাধ্য হয়ে অনুমোদন দিতে হয়েছে।' তিনি আরও বলেন, এখন বিশেষ পরিদর্শনে এই অনিয়ম ধরা পড়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আকাশচুম্বী হয়েছে। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৯ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৬১১ কোটি টাকা (মোট ঋণের ৪.৯ শতাংশ)। ব্যাংকটি বর্তমানে ৭ হাজার ১৬ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে।

স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে এইচবিএম ইকবাল ও তার ছেলে মঈন ইকবাল ২০২৫ সালের ১২ জানুয়ারি তাদের পদ থেকে ইস্তফা দেন। তার আরেক ছেলে ইমরান ইকবালকে নতুন চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এইচবিএম ইকবালের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করছে। গত এইচবিএম ইকবাল ও তার স্ত্রীর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। তবে প্রিমিয়ার ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইকবাল ও তার স্ত্রী এখন বিদেশে রয়েছেন। নভেম্বরে ইকবাল, তার স্ত্রী ও তাদের তিন সন্তানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়।

এ ব্যাপারে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পরিদর্শনে এসব সন্দেহজনক লেনদেনের চিত্র উঠে এসেছে। এতে ব্যাংকটিকে কীভাবে ইকবাল পরিবারের সম্পত্তি ও অন্যান্য ব্যবসার জন্য ব্যক্তিগত এটিএমের মতো ব্যবহার করা হয়েছে, অথচ এই সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ আকাশচুম্বী। অন্যরা যেখানে ভুয়া নামে ঋণ নিয়ে আলোচনায়, সেখানে ইকবাল টাকা হাতানোর এক সূক্ষ্ম মডেল তৈরি করেছিলেনতিনি নিজের মালিকানাধীন বনানীর 'ইকবাল সেন্টার' তারই মালিকানাধীন ব্যাংকের কাছে ভাড়া দিয়েছেন।

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন