সাবেক তিন গভর্নরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক
শামসুল আলম সেতু :
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৬:৩৫ পিএম
আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার
একগুচ্ছ দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) সাবেক তিন গভর্নরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ব্যাংক খাতে সংস্কার করার জন্যই দুর্নীতি দমন কমিশন শক্ত হাতে বিষয়টির খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। ব্যাংকের আর্থিক দৈন্যদশা কাটিয়ে তোলার জন্যই অন্তর্বর্তী সরকার এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সাবেক তিন গভর্নর হচ্ছেন- আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম,ঋণ খেলাপিদের ছাড় দিয়ে নীতিমালা জারি,রিজার্ভ চুরি,হলমার্ক জালিয়াতি,হলমার্ক জালিয়াতি,এস আলম গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে বিগত ১৫ বছর ব্যাংক খাত ধ্বংস করা হয়েছে।
দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ,ব্যাংক খাতে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির সর্বোচ্চ ক্ষমতা গভর্নরের হাতে। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদেরও চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা নেওয়ার দিনে গভর্নর ছিলেন বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল তাঁর মেয়াদ শেষ হলে নতুন গভর্নর হন আতিউর রহমান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পরে তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁর সময়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দিয়ে বিতর্কিত হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় ব্যাংক খাতের সংস্কার করা। কারণ,আগের সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এই খাতের। রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল হয়েছে। একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়। এই সুযোগে বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়।
এরই মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন ‘অনিয়মের’ পাশাপাশি অন্যদের জন্য ঋণ জালিয়াতির সুযোগ তৈরিসহ একগুচ্ছ অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি সংস্থাটির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে গভর্নরের দায়িত্ব পালন করা তিনজনের নথিসহ ২৩ ধরনের নথি তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে।
২০১৬ সালে সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির গভর্নর হলে একের পর এক ব্যাংক দখল হতে থাকে। এসব ব্যাংকে নির্বিচার লুটপাট শুরু করে দখলকারীরা। নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার কৌশলও দেখা যায় তাঁর সময়ে। ২০২২ সালে গভর্নর পদে বসানো হয় আরেক সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারকে। তাঁর আমলেও আগের ধারা অব্যাহত থাকে। পাশাপাশি টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয় লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোকে। এসব টাকাও ঋণের নামে বের হয়ে যায়। এভাবে লুটপাটের সহযোগী হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২৪ এর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে আব্দুর রউফ তালুকদার লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান এবং পদত্যাগ করেন।
২০০৯ সালের পয়লা মে গভর্নর পদে নিয়োগ পান আতিউর রহমান। তাঁর মেয়াদের শুরুতে ততটা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে দুর্বলতা দেখা দেয়। এই সুযোগে সোনালী ব্যাংকে হলমার্কের জালিয়াতি ফাঁস হয়। এর জেরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনে সরকার। তবে তাঁর সময়ে আবার বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি হলেও রাজনৈতিক চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করেও তা রুখতে পারেনি। ২০১২ সালে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের উদ্যোগ নেওয়া হলে কারা তা পাবেন, সেই তালিকা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে গভর্নরকে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতাদের ৯ ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন সুবিধা পায় বেক্সিমকো, এমআর গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, কেয়া গ্রুপ, যমুনা, থার্মেক্স, শিকদার, আবদুল মোনেম ও এননটেক্স গ্রুপ। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় প্রশ্ন ওঠে। ওই সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তনের দাবি ওঠে। তখন সেই পথে না গিয়ে আতিউর রহমান চার স্বতন্ত্র পরিচালক দিয়ে ব্যাংকটির তদারকি জোরদার করেন। ফলে তাঁর মেয়াদে রক্ষা পায় ইসলামী ব্যাংক। তবে আত্মপ্রচার তাঁকে বিতর্কিত করে। এ বিষয়ে সাবেক গর্ভনর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তাঁর কোন বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরি হয় এবং ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করলে ওই বছরের ২০ মার্চ সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির গভর্নর পদে নিয়োগ পান। ২০১৭ সালের শুরুতে ইসলামী ব্যাংক ও পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) দখল করে এস আলম গ্রুপ। গভীর রাতে ও বাসায় বসে এই দখল অনুমোদন দেন ফজলে কবির। এরপর এসব ব্যাংকে লুটপাট শুরু হলে তিনি তদারকি কমিয়ে দেন। গভর্নরের অফিস ও বাসভবনে এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তাদের অবাধ যাতায়াত শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও কোন বিভাগে কারা দায়িত্বে থাকবেন, তাতেও হস্তক্ষেপ শুরু করে গ্রুপটি। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও বিভিন্ন পদের জন্য এস আলম গ্রুপ নির্ভর হয়ে পড়ে। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনায় আবার একাধিক ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়। ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার কৌশলও নেওয়া হয়। সুদের হার ৯ শতাংশে আটকে রেখে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হয়। এতে পুরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে ব্যাংক খাত। এ সময় ব্যবসায়ীদের চাপে ফজলে কবিরকে গভর্নর পদে রাখতে আইনে পরিবর্তন আনে সরকার। এ নিয়ে জানতে ফজলে কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।
২০২২ সালের জুলাইয়ে আরেক সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর পদে দায়িত্ব নেন। তাঁর আমলেও আগের মতো বেনামে ঋণ ও জালিয়াতি করে ঋণ বিতরণের ধারা অব্যাহত থাকে। তিনি অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হন। পরে অনিয়মে যুক্ত ব্যবসায়ীদের সহযোগী হয়ে পড়েন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাঁর সময়ে টাকা ছাপিয়ে লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়। এসব টাকাও ঋণের নামে তুলে নেয় এস আলম গ্রুপ। আবার রিজার্ভ থেকেও ডলার দেওয়া হয় তৎকালীন সরকারের কাছের ব্যবসায়ীদের। তাঁর সময়ে আর্থিক তথ্য প্রকাশ সীমিত করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের পতন ঘটলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে পদত্যাগ করেন।
একইসঙ্গে ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার পর নতুন নীতিমালা জারি হওয়ার পর সুবিধাপ্রাপ্ত বেক্সিমকো গ্রুপ, এম আর গ্রুপ, রতন গ্রুপ, কেয়া গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, বিবিএস গ্রুপ, আব্দুল মোনেম গ্রুপ, এনানটেক্স গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ গ্রহণের বিস্তারিত নথি চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির নথিও তলব করা হয়েছে।



