৫৫ বছর আগে দুই বিজ্ঞানীর ভুল থেকে যেভাবে জন্ম ইন্টারনেটের
অনলাইন ডেস্ক :
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:২৬ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
আজ আমরা যে ইন্টারনেট ছাড়া একমুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না, তার জন্ম হয়েছিল একেবারেই নীরবে—একটি ছোট ভুলের মধ্য দিয়ে। সময়টা ছিল ১৯৬৯ সালের ২৯ অক্টোবর। স্থান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য। সেদিন কেউ জানত না, দুটি অক্ষরের ব্যর্থ যাত্রা মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় যোগাযোগ বিপ্লবের সূচনা করবে।
সেদিন ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে বসে তরুণ গবেষক চার্লি ক্লাইন এবং প্রায় সাড়ে তিনশ মাইল দূরে আরেক গবেষণাগারে থাকা গবেষক বিল ডুভাল প্রথমবারের মতো দুটি কম্পিউটারকে যুক্ত করার চেষ্টা করেন। লক্ষ্য ছিল একটি শব্দ পাঠানো—‘লগইন’। কিন্তু পুরো শব্দ আর পাঠানো হলো না। প্রথমে গেল ‘এল’, তারপর ‘ও’। তৃতীয় অক্ষর পাঠানোর আগেই সংযোগ ভেঙে পড়ল। সিস্টেম বিকল হয়ে পড়ল।
তখন কেউই ঘটনাটিকে গুরুত্ব দেননি। কিন্তু ইতিহাস পরে লিখেছে, এই ‘এল’ আর ‘ও’ই ছিল পৃথিবীর প্রথম ইন্টারনেট বার্তা।
এ ঘটনার পেছনে ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রকল্প। শীতল যুদ্ধের উত্তাল সময়ে যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস হলেও যেন তথ্য আদান-প্রদান বন্ধ না হয়, এই চিন্তা থেকেই তৈরি হয়েছিল এ প্রকল্প। তখনকার প্রচলিত টেলিফোন লাইনের বদলে নতুন এক পদ্ধতিতে তথ্য পাঠানোর চেষ্টা চলছিল, যেখানে তথ্য ভেঙে ছোট ছোট অংশে পাঠানো হতো।
সেই সময়ের বিশালাকৃতির কম্পিউটারগুলো ছিল প্রচণ্ড শব্দ করা যন্ত্র। আজকের একটি স্মার্টফোনের তুলনায় সেগুলোর ক্ষমতা ছিল নগণ্য। তবুও সেই সীমিত প্রযুক্তি দিয়েই গবেষকরা ভবিষ্যতের পথ খুলে দিয়েছিলেন।
দুর্ঘটনা, যা ইতিহাসের সৃষ্টি—শুনতে রহস্যময় মনে হলেও সত্য ঘটনা আসলে এভাবেই গড়ে উঠেছিল। যেদিন এই ইতিহাস ঘটেছিল, সেদিন রাতে সংযোগ ভেঙে পড়লেও গবেষকরা হাল ছাড়েননি, হননি কেউ আশাহত। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই সমস্যার সমাধান করে পুরো শব্দ পাঠাতে সক্ষম হন তারা। কিন্তু ইতিহাস মনে রেখেছে প্রথম সেই ব্যর্থ প্রচেষ্টাকেই।
ব্যর্থ প্রচেষ্টা থেকে সফলতা পাওয়ার পর নির্মাতা চার্লি ক্লাইন পরে বলেছিলেন, ‘আমরা তখন বুঝতেই পারিনি, আমরা কী করে ফেলেছি। আমাদের একমাত্র চিন্তা ছিল—যন্ত্রটা কাজ করছে কি না।’
এই উদ্ভাবনের পেছনে চার্লি ক্লাইন ও গবেষক বিল ডুভাল মাঠ পর্যায়ে কাজ করলেও এই বিপ্লবকে সফল করতে তাদের পাশে ছিলেন অসংখ্য গবেষক, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসক এবং সরকারি সহায়তা। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তারই ফল আজকের ইন্টারনেট।
সেই সময় ক্যালিফোর্নিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর চাক ইয়ং ছিলেন এই গবেষণা পরিবেশ তৈরির অন্যতম কারিগর। তার নেতৃত্বে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসংখ্য যুগান্তকারী কাজ হয়। সম্প্রতি তার মৃত্যুতে সেই ইতিহাস আবার আলোচনায় এসেছে।
৫৬ বছরে ইন্টারনেট বদলে দিয়েছে পুরো পৃথিবী। যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসা, চিকিৎসা—সবখানেই এর প্রভাব অপরিসীম। কিন্তু একই সঙ্গে এসেছে নতুন উদ্বেগ। ভুল তথ্য, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, সামাজিক বিভাজন—সবই আজ বড় প্রশ্ন।
যে ইন্টারনেট একদিন মুক্ত তথ্যবিনিময়ের স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল, আজ তা অনেকাংশে কয়েকটি বড় করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে। এই বাস্তবতা নিয়ে উদ্বিগ্ন সেই প্রথম দিনের বিজ্ঞানীরাও।
এদিকে আজ যখন আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে প্রবেশ করছি, তখন ১৯৬৯ সালের সেই গল্প নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তখন যেমন সহযোগিতা ছাড়া সাফল্য সম্ভব হয়নি, আজও তেমন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার ও সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
ইন্টারনেটের জন্ম আমাদের শেখায় প্রতিটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি যেমন সম্ভাবনা নিয়ে আসে, তেমনি দায়িত্বও নিয়ে আসে। সেই দায়িত্বশীল ব্যবহারের ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর রূপ।
একটি ব্যর্থ বার্তা, দুটি অক্ষর আর একদল স্বপ্নবান মানুষের চেষ্টা—এ নিয়েই শুরু হয়েছিল ডিজিটাল যুগ। ৫৬ বছর পর দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারি, ইতিহাস সব সময় বজ্রনিনাদ দিয়ে শুরু হয় না। কখনো কখনো ইতিহাস জন্ম নেয় নীরব এক ভুল থেকে।



