সরকার উৎখাতের চেষ্টা
রূপগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশা ৪ দিনের রিমান্ডে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন মোশাকে ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মতিঝিল থানায় দায়ের করা সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশার বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ অর্ধ শতাধিক মামলা রয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৬ বছরের শাসনামলে মোশার হাতে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন রূপগঞ্জের সাধারণ মানুষ। তাই মোশাকে রিমান্ডে নেওয়ার খবরে তারা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। সেইসঙ্গে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৫ নভেম্বর গভীর রাতে নাশকতার চেষ্টাকালে রাজধানীর ভাটারা এলাকা থেকে মোশারফ হোসেন মোশাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এসময় তার মোবাইল ফোনে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া ঢাকায় নাশকতার জন্য পেশাদার সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও টাকা যোগানের তথ্যও বেরিয়ে আসে।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মোশার কাছ থেকে অন্তত ৫৬ জন পেশাদার অপরাধীর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ওই অপরাধীরা ঢাকায় যানবাহনে আগুন ও বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণে পারদর্শী। আর তাদের দলনেতা হচ্ছে এই মোশা। সূত্রমতে, মোশার কাছ থেকে পাওয়া তালিকা অনুযায়ী অনেককেই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরপরই তাকে মতিঝিল থানায় দায়ের করা নভেম্বর মাসের (মামলা নং-১১) একটি মামলায় গতকাল ৪ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এই মোশা ভয়ঙ্কর অপরাধী। এর আগেও কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছে সে। সম্প্রতি রূপগঞ্জ ঘিরে তার অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার খবর প্রকাশ হয়ে পড়ায় ঢাকায় এসে আস্তানা গাড়ে। গড়ে তোলে অস্ত্র ও মাদকের সিন্ডিকেট। রিমান্ডে তাকে এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এরইমধ্যে তাকে কারাগার থেকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে রূপগঞ্জের নাওড়া পাড়া এলাকা থেকে মোশার সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু হয়। ধীরে ধীরে কায়েতপাড়া ইউনিয়ন থেকে শুরু করে গোটা রূপগঞ্জের আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠে মোশা বাহিনী। আওয়ামী লীগের একাধিক প্রভাবশালী নেতার সেল্টারে থেকে রূপগঞ্জে অস্ত্র ও মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে মোশা। এলাকার সাধারণ মানুষের জমি ও বাড়িঘর দখল, চাঁদাবাজি, চাঁদার দাবিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, মানুষের বাড়িঘরে হামলা এমনকি নীরিহ মানুষকে মোশার টর্চার সেলে তুলে এনে নির্যাতন ছিলো নিয়মিত ঘটনা। চাঁদা না পেলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপরও হামলা চালানো হতো। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার ছত্রছায়ায় বিএনপি নেতাকর্মীদের জমি দখল, তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতো মোশা ও তার বাহিনী। ওই সময় একাধিক বার র্যাব ও পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলেও যেতে হয়েছিলো মোশাকে। তবে প্রভাবশালীদের তদবিরে জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠে সে।
পুলিশের গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনকারীদের দমনে মোশা বাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। শুধু তাই নয়, মোশা নিজে নেতৃত্ব দিয়ে রূপগঞ্জ থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জ এমনটি রাজধানীর ভাটারা ও বাড্ডা এলাকায় আন্দোলনকারীদের উপর একাধিক হামলা ও গুলি চালিয়েছে। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকার পতন হলে পুরোপুরি আত্মগোপনে চলে যায় মোশা ও তার বাহিনী। তবে থেমে থাকেনি তার সন্ত্রাসী কার্যক্রম। নির্বিঘ্নে এলাকায় অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা ও চাঁদাবাজি চালিয়ে গেছে। এর মাঝে ভোল পাল্টে বিএনপির সেল্টার নেওয়ার চেষ্টা করেছে গত এক বছর। তবে সে চেষ্টা সফল না হওয়ায় আত্মগোপনে থেকেই আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে ব্যাপক সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সংঘটনের পরিকল্পনা করছিল সে।
এলাকাবাসী জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঝটিকা মিছিলের জন্য নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা দিতো মোশা। তাছাড়া ভাড়াটে সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিলের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলো মোশা বাহিনী। আগামী নির্বাচনকে বানচাল করতে এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে রূপগঞ্জসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা এমনকি রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করেছিলো মোশা। তার সঙ্গে পলাতক আওয়ামী লীগের একাধিক প্রভাবশালী নেতার যোগাযোগ ছিলো গত ১৫ মাস ধরে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৫ মার্চ রূপগঞ্জ এলাকায় নিরীহ গ্রামবাসীর উপর অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় মোশা ও তার বাহিনী। সে দিন মোশা বাহিনীর গুলিতে নাওড়া পাড়া এলাকায় ১০ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধ শতাধিক মানুষ আহত হন। এর আগের বছর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায় র্যাব। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় কুড়িগ্রাম থেকে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেলেও আড়াই মাসের মধ্যে জামিন পেয়ে যায় সে। এরপর হয়ে ওঠে আরও বেপরোয়া। মোশার নেতৃত্বে তার সশস্ত্র ক্যাডার নিরব, স্বাধীন, সাখাওয়াত উল্লাহ, আব্বাস, নাজমুল, রুবেল, আনোয়ার, জয়নাল, তাজেল, রিফাত, রায়হান, আলহাদি, জাগু, ভুট্টু, চোরা দুলাল, আব্দুল, আরমানসহ ৪০ থেকে ৫০ জন সন্ত্রাসী পিস্তল, টেঁটা, বল্লম, রামদা, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, সামুরাইসহ নানা ধরনের দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে নাওড়ায় নিরীহ মানুষের ওপর চালায় একের পর এক হামলা।



