সংকুচিত ভূমি, থমকে যাওয়া জীবিকা
জলবায়ুর চাপে ক্ষয়ে যাচ্ছে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:১৩ পিএম
নদী, পাহাড় আর বঙ্গোপসাগরের আলতো বেষ্টনী একসময় টেকনাফকে দিতো প্রাকৃতিক আশীর্বাদ। সেই সমুদ্রই এখন বদলে গেছে নির্মম গ্রাসে—জলবায়ু পরিবর্তনের তাপে উথাল সাগর প্রতিদিন একটু করে কেটে নিচ্ছে টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনের শরীর। গত দুই দশকে ভাঙনের গতি এমন বেড়েছে যে চোখের সামনে মিলিয়ে গেছে আবাদি জমি, বসতি আর মানুষের বহুদিনের স্বপ্নবাগান।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, টেকনাফে সাগর গিলে খেয়েছে কয়েক শ হেক্টর চাষযোগ্য জমি। সেন্ট মার্টিনের উপকূলরেখা পিছু হটেছে ৪০–৫০ মিটার—হারিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, নারিকেলের বাগান, পরিচিত সবুজ গোলার ছায়া। লবণাক্ততা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আগে যেখানে ধান দুলতো দুরন্ত বাতাসে, এখন সেখানে লবণচাষও টিকে থাকে না।
ইউপি সদস্য সৈয়দ আলমের বর্ণনা আরও কঠিন বাস্তব তুলে ধরে—১৯৯১ সালের ঝড়ে যে দ্বীপ ছিল ১৩.৩৭ বর্গকিলোমিটার, তা এখন নেমে এসেছে মাত্র ১১-তে। কৃষি ও মৎস্যচাষ হারিয়ে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীলতাই এখন একমাত্র ভরসা, তাও কমছে। দ্বীপবাসীদের দাবি, টেকসই বেড়িবাঁধ আর ম্যানগ্রোভ বনায়ন ছাড়া রক্ষা নেই।
টেকনাফের বাসিন্দা জহির আহমেদের অভিযোগ—রাতের অন্ধকারে ঝাউগাছ কেটে ফেলছে একদল দুর্বৃত্ত, আর সেই ক্ষত দিয়ে অনায়াসে ঢুকে পড়ছে সমুদ্রের পানি।
আন্তর্জাতিক মানবিক তথ্যভাণ্ডার রিলিফ ওয়েবের ২০২৩ সালের গবেষণা বলছে—টেকনাফে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বেশি, বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কম। বাতাসের গতি বাড়ায় সাবরাং ইউনিয়নকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং মাঝারি ঝুঁকিতে।
পরিবেশকর্মী জিমরান মো. সায়েকের ভাষায়, কক্সবাজারের ভূপ্রকৃতি এমন যে এখানে দুর্যোগ আসে ঘন ঘন, আর তার আঘাতে টেকনাফবাসীর জীবিকা প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হয়।
শাহপরীর দ্বীপের সাবেক সদস্য নুরুল আমিন জানান, একসময় তিনটি গ্রাম পানিতে মিশে গেছে বেড়িবাঁধের অভাবে। আগামী বছর আরও তিন ফুট পানি বাড়তে পারে—বর্তমান বাঁধ কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়েই বড় উদ্বেগ।
কৃষি কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির সতর্ক করেন—এখনই শক্ত বেড়িবাঁধ, গাছ লাগানো ও লবণ-সহিষ্ণু ফসলের উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতের মানচিত্রে টেকনাফ নামটা শুধু স্মৃতিই হয়ে যেতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন জানান, ভূমি হারানো ও কৃষি ক্ষতির প্রভাব কমাতে সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি। টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও কৃষকদের জলবায়ুসহিষ্ণু চাষে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
উপকূলীয় বন কর্মকর্তা ভূমিকা আহমেদ বলেন—ঝাউবাগান উপকূলের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুবার, তার বিকল্প গাছ নিয়েও গবেষণা চলছে। ইতোমধ্যে মেরিন ড্রাইভ উপকূলে ১০০ হেক্টর বনায়ন করা হয়েছে।
সমুদ্রের এই অদৃশ্য অগ্রযাত্রা থামাতে এখন স্থানীয়দের চোখ সরকারের দিকে—তারা চান সুরক্ষা, চান টেকসই কাঠামো, আর চান তাদের দ্বীপ ও উপকূলের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার নিশ্চয়তা।



