গাজীপুরের টঙ্গীতে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে হঠাৎ বেড়ে গেছে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকের বেচাকেনা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কৌশলে মাদকের চালান ঢুকছে এই এলাকায়, আর সেগুলো পৌঁছে যাচ্ছে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের হাতে। টঙ্গী বাজারসংলগ্ন হাজি মাজার বস্তি এখন মাদকের ‘সবচেয়ে বড় আখড়া’ হিসেবে পরিচিত।
টিনের ঘরে ঘেরা সরু বস্তিটিতে ২৪ ঘণ্টা প্রকাশ্যেই চলে মাদকের লেনদেন। শুধু হাজি মাজার বস্তি নয়—টঙ্গীর মোট ২৩টি বস্তিই এখন মাদক ব্যবসার বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষ, রক্তপাত এবং আতঙ্ক এখন সেখানে নিত্যদিনের ঘটনা।
মাজার বস্তিতে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে অলিগলিতে দাঁড়ানো মাদক বিক্রেতাদের। সংকেত দিয়ে গ্রাহক যাচাই, পরে নিয়ে যাওয়া হয় টিনঘরে—যেখানে চলছে মাদকের আড্ডা। বস্তির প্রায় প্রতিটি ঘরেই চলছে একই চিত্র। বহিরাগতদের প্রবেশ সহজ নয়; সাংবাদিক বা প্রশাসনের লোক ঢুকলেই নজরদারির দায়িত্বে থাকা কারবারিদের ‘তথ্য বাহিনী’ খবর পৌঁছে দেয় মুহূর্তে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেন পুলিশের একাংশ ও রাজনৈতিক নেতারা। পুলিশের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনের তথ্যও একই কথা বলছে—বিভিন্ন থানার ওসি মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেন, যার একটি অংশ যায় ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে।
ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে মাদকনিয়ন্ত্রণের ‘রাজনৈতিক অভিভাবক’ও পাল্টেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের অনুসারীরা নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতার হাতে। তবে বিএনপি নেতারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করছেন।
সূত্র জানিয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর হাজি মাজার বস্তিতে নিয়ন্ত্রণ করছেন টঙ্গী পূর্ব থানা বিএনপির সভাপতি সুমন সরকার। অন্যদিকে এরশাদনগর বস্তিও বড় আখড়া—এখানে কোনো প্রতিবাদ করলে থাকে প্রাণনাশের ভয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ—কিছু বস্তিতে পুলিশ প্রকাশ্যে ডিউটি করলেও মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এর কারণ হিসেবে তারা প্রশাসনের কিছু সদস্যের ‘অসৎ যোগসাজশ’-কে দায়ী করছেন।
জিএমপি কমিশনার মো. ইসরাইল হাওলাদার অবশ্য সতর্ক করে বলেছেন—কোনো ওসির বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ হলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও জিএমপির তালিকায় দেখা যায়—গাজীপুরের ৩৩টি বস্তিতেই সক্রিয় মাদক কারবার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাজি মাজার, এরশাদনগর, টঙ্গী স্টেশন, জিন্নাত মহল্লা, কড়ইতলা, মিল ব্যারাক, শিববাড়ী রেলগেট, ব্যাংকের মাঠ, আমতলী কেরানীটেক, বোর্ডবাজার, গাছা, সালনা, পুবাইল, ভোগড়া এবং কাশিমপুর কারাগার সংলগ্ন বস্তি।
জিএমপি অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) তাহেরুল হক চৌহান বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর মাদক কারবারিরা আগের মতো পুলিশকে ভয় পায় না, ফলে জোরালো অভিযান চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে প্রতিদিনই মাদক উদ্ধার ও গ্রেপ্তার অভিযান চলছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) গাজীপুর শাখার সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, এখন গাজীপুরে মাদকদ্রব্য প্রকাশ্যেই বিক্রি হয়—একসময় যা গোপনে হতো। তার মতে, পুলিশ সদর দপ্তর, জিএমপি এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বিত বড় অভিযান ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কোনো পথ নেই।



