১৭ বছর পরও সিডরের মুছেনি ক্ষত, উপকূলজুড়ে স্থায়ী ভাঙন-ভয় ও অনিশ্চয়তার জীবন
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৩৩ পিএম
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর—বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষের স্মৃতিতে এই দিনটি এক চিরস্থায়ী শোকের প্রতীক। প্রলয়ঙ্করী সুপার সাইক্লোন ‘সিডর’ যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, ১৭ বছর পেরিয়েও সেই ক্ষতচিহ্ন এখনো শুকোয়নি সাতক্ষীরা-খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের জনপদে। দুর্বল বেড়িবাঁধ, জীবিকার অনিশ্চয়তা, পুনর্বাসনের ঘাটতি এবং স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে আজও আতঙ্কে দিন কাটান এখানকার মানুষ।
সেই রাতে ঘণ্টায় ২৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে সিডর। ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস গ্রাস করে নেয় হাজারো ঘরবাড়ি, ফসল ও গবাদিপশু। বরগুনা, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালীগঞ্জসহ বিস্তীর্ণ এলাকা হয়ে ওঠে ধ্বংসস্তূপ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই দুর্যোগে প্রাণ হারান অন্তত ৩ হাজার ৩৬৩ মানুষ এবং আহত হন ৫৫ হাজারের বেশি। ধ্বংস হয় প্রায় ৬ লাখ বসতঘর, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও ১০ লাখ।
স্মৃতিতে আজও সেই বিভীষিকা
শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের সফুরা বেগম এখনো ভুলতে পারেন না সেই রাতের দৃশ্য। তাঁর ভাষায়,
সারি সারি লাশ চোখের সামনে ভেসেছিল। কাপড়ের অভাবে অনেক লাশ পলিথিনে মুড়িয়ে দাফন করতে হয়েছে। দুধের শিশুকে কোলে নিয়ে চার দিন না খেয়ে ছিলাম।
কৃষক আবদুল করিমের স্মৃতিতেও সেই রাত জেগে আছে।রাতে হঠাৎ পানি ঢুকে ঘর ভেঙে গেল। গবাদিপশু, ফসল সব তলিয়ে গেল। বাচ্চাদের চিৎকার আর দেয়াল ভাঙার শব্দ আজও ভোলা যায় না। তালা ও শ্যামনগরের বহু পরিবার আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। দুবলারচরে মাছ ধরতে গিয়ে নিহত অজিত ও গৌর হালদারের পরিবারগুলোর নিত্যদিনের জীবনে রয়ে গেছে অনটন।
অজিতের স্ত্রী রিতা হালদার বলেন, স্বামী হারানোর পর তিন সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঋণ শোধ করতেই সব চলে যায়।
গৌর হালদারের স্ত্রী আরতি হালদারের আক্ষেপ—বিপর্যয়ের এত বছর পরও তাদের খোঁজ কেউ নেয় না।
স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, সিডরের পর শ্যামনগর, আশাশুনি, কালীগঞ্জ ও বুড়িগোয়ালিনীতে ফসল উৎপাদন ৬০–৭০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা এখনো সেই ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে দেয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ চলমান। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, উপকূলের বহু স্থানে বাঁধ অরক্ষিত রয়ে গেছে। সামান্য জোয়ারেই গ্রাম প্লাবিত হয়, পুকুর-ঘের নষ্ট হয়ে যায়, পানীয় জলের সংকট আরও বেড়ে যায়।
গাবুরার মহসিন গাজী বলেন, মাছ, কাঁকড়া, মধু সংগ্রহ করেই সংসার চলে। জোয়ার এলেই বাঁধ ভেঙে যায়। তখন ঘর, জমি, পানি—কিছুই থাকে না। চিকিৎসার জন্য নদী পার হতে হয়। এই জীবন যেন শেষ না হওয়া দুর্ভোগ।
পরিবেশ ও উন্নয়নকর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত মনে করেন, সিডর ছিল চূড়ান্ত সতর্কবার্তা। ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড় আরও শক্তিশালী হতে পারে। টেকসই বাঁধ ও কার্যকর সতর্কতা ব্যবস্থা না হলে উপকূল ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
তার মতে, সিডরের দুঃসহ স্মৃতি, দারিদ্র্য এবং অরক্ষিত বাঁধ—এই তিনটির সম্মিলিত চাপ এখনো সাতক্ষীরার উপকূলবাসীর জীবনকে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন, সুপেয় পানির স্থায়ী সমাধান এবং শক্তিশালী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। ১৭ বছর পরও সিডর তাই শুধু একটি দুর্যোগ নয়—একটি অমোচনীয় বেদনা ও সতর্কবার্তা।



