টেকনাফে মানবপাচার রোধে অভিযান: এক মাসে উদ্ধার ৩৪৭ জন, আটক ৪৭
কক্সবাজার প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫১ পিএম
ছবি : টেকনাফে মানবপাচার রোধে যৌথ বাহিনীর অভিযান
কক্সবাজারের টেকনাফকে ঘিরে মানবপাচার রোধে একের পর এক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে বিজিবি, কোস্টগার্ড, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। কখনো গহীন পাহাড়ে, কখনো সাগর উপকূলে পরিচালিত এসব অভিযানে গত এক মাসে ১৩টি অভিযানে ৩৪৭ জন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার এবং ৪৭ জন পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) মধ্যরাতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ উপকূলে অভিযান চালিয়ে পাচারের আগমুহূর্তে ২৯ জনকে উদ্ধার করে বিজিবি। এ সময় মানবপাচার চক্রের তিন সদস্যকে আটক করা হয়।
বিজিবির টেকনাফস্থ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আশিকুর রহমান জানান, এর আগে ভোরে রাজাছড়ার গহীন পাহাড়ে সশস্ত্র পাচারকারীদের আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ৬ জন জিম্মিকে উদ্ধার করা হয় এবং একজনকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়। পালিয়ে যায় চক্রের আরও ৮ সদস্য।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সন্ধ্যায় মেরিন ড্রাইভের বিভিন্ন পয়েন্টে নজরদারি বাড়ানো হয়। গভীর রাতে সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করে বিজিবি সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ২৯ জন ভুক্তভোগীকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে উদ্ধার করে। আটক তিন পাচারকারী হলেন—মো. সলিম (৩৫), নুরুল আবছার (১৯) এবং মনসুর আলম (২২)। অভিযানে আরও ৯-১০ জন পালিয়ে গেলেও তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
অভিযানে একটি চাকু, একটি মোটরসাইকেল ও একটি সাম্পান নৌকা জব্দ করা হয়েছে। বিজিবি অধিনায়ক বলেন, “টেকনাফ সীমান্তে পাহাড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত কোনো অপরাধীর জন্য এক ইঞ্চি জায়গাও নিরাপদ নয়। মানবতা বিরোধী অপরাধ বরদাশত করা হবে না।”
এদিকে, বাহারছড়ার কচ্ছপিয়া ও বড়ডেইল এলাকায় গড়ে উঠেছে একাধিক গোপন বন্দিশিবির। এসব চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে আবদুল আলী, মো. হোসেন, সাইফুল ও নিজাম। তাদের অধীনে শতাধিক দালাল কাজ করছে, যাদের মধ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মাঝি-মাল্লা এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কিছু বাসিন্দাও রয়েছে।
বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফরিদ উল্লাহ জানান, “১৩ হাজার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সন্ধ্যার পর কেউ বাইরে বের হয় না। পর্যটকদের মেরিন ড্রাইভে একা চলাচল থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”
সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাফিকিং ইন পারসনস রিপোর্ট-২০২৫-এ বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও এখনও ন্যূনতম মান পূরণে ব্যর্থ।” ইউএনএইচসিআর ও আইওএম জানিয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাচার এখন সবচেয়ে বড় হুমকি।
রোহিঙ্গা নেতারা জানান, উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেড়েছে। দালালরা ১০-২০ হাজার টাকা নগদ ও বাকিতে আরও অর্থ নেওয়ার শর্তে তাদের ফাঁদে ফেলছে।
২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজারে সাগরপথে পাচারের সময় ১,১৩৪ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা। এসব ঘটনায় ৮৫টি মামলায় ১,২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং ৫০৮ জন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
টেকনাফ থানার ওসি আবু জায়েদ নুর বলেন, “অনেক যাত্রী স্বেচ্ছায় দালালদের সঙ্গে যায়, যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। তবে স্থানীয় পর্যায়ে সক্রিয় পাচারকারীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”
র্যাব-১৫ এর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান জানান, “এই চক্রের সদস্যরা অস্ত্রধারী। পাহাড়ে গুলি চালিয়ে ভয় সৃষ্টি করে তারা ভুক্তভোগীদের বন্দি করে রাখে।”
মানবপাচার রোধে যৌথ বাহিনীর এই ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।



