রামুর বৌদ্ধপল্লী থেকে নিখোঁজ উত্তম বড়ুয়ার খোঁজ মিলল ১৩ বছর পর
কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৭ পিএম
ছবি-যুগের চিন্তা
কক্সবাজারে রামুর বৌদ্ধপল্লীতে সহিংসতার দীর্ঘ ১৩ বছরের বেশী সময় ধরে নিখোঁজ থাকা আলোচিত সেই উত্তম বড়ুয়ার অবশেষে দেখা মিললো ফ্রান্সের বিমানবন্দরে। যার ফেইসবুক আইডিতে পবিত্র কোরআন অবমাননাকর ‘ট্যাগ করা ছবি পোস্ট’কে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ওই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।
সোমবার সকালে ( ফ্রান্সের সময় রোববার রাতে ) উত্তম বড়ুয়া নিজের ফেইসবুক আইডিতে স্ত্রী ও সন্তানসহ একটি ছবি পোস্ট করে এই তথ্য জানান দিয়েছেন।
উত্তম বড়ুয়ার ব্যবহৃত ‘ বড়ুয়া অনির্বাণ এন সেন’ ( Barua Anirban N Sen ) নামের ফেইসবুক আইডিতে স্ত্রী ও সন্তানসহ নিজের একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন- “ দীর্ঘ তের বছর তের দিন পর আমাদের দেখা। জীবনের স্মরণীয় একটা রাত। “
সোমবার রাতে ওই ফেইসবুক আইডিতে আরেকটি পোস্টে লিখেছেন-সকল কল্যাণমিত্র এবং শুভাকাঙ্খীদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
‘বড়ুয়া অনির্বাণ এন সেন’ নামে ব্যবহৃত উত্তম বড়ুয়ার সেই পোস্টের ছবিটি সোমবার রাতে শেয়ার করে পোস্ট করেছেন গবেষক ও সাংবাদিক এ কে এম আতিকুজ্জামান।
মূলত এরপরই রামুর বৌদ্ধপল্লীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ থাকা আলোচিত সেই উত্তম বড়ুয়াকে ফ্রান্সের বিমানবন্দরে দেখতে পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে।
শেয়ার করা ছবিসহ পোস্টে সাংবাদিক এ কে এম আতিকুজ্জামান লিখেছেন- “ উত্তম হারিয়ে গিয়েছিল। ১৩ বছর ১৩ দিন পর অবশেষে তাঁর খোঁজ পেল পৃথিবী। ১৩ বছর ১৩ দিন নিতান্ত কম সময় নয়। যৌবনের শুরু থেকে পুরো এক যৌবন -- দীর্ঘের চেয়েও দীর্ঘ এক কাল।
প্রমাণিত মিথ্যা অপবাদে প্রিয় স্বদেশ হারিয়ে পথে পথে ধুকেছে উত্তম। ঘরে অভাবী মা-বাবার সংকট ক্রমে ক্রমে বেড়েছে।
উত্তমের স্ত্রী রিতার কোলে তখন তিন বছরের বাচ্চা। সমাজের, পরিবারের, আত্মীয়স্বজনের হাজারো লাঞ্ছনা-গঞ্জনা মুখ বুঁজে সহ্য করে কোনরকমে খেয়ে পরে একা একটি মা শিশু সন্তানকে নিয়ে যুদ্ধ করে গেছে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত। সে যুদ্ধে বিজয়ীও হয়েছে বলা যায় -- আদিত্য জিপিএ ৫ নিয়ে এসএসসি পাস করেছে এবার।
অপরাধ না করেও আজ ১৩ বছর ১৩ তিন ফেরারি রয়েছে উত্তম। কোন অপরাধ না করেই ১৩ বছর ১৩ দিন ধরে স্ত্রী-পুত্রের স্পর্শ, আদর, ভালবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল উত্তম। রিতা-আদিত্যেরও বিন্দুমাত্র অপরাধ ছিল না, তবুও স্বামীর সোহাগ, পিতার স্নেহ তাদের ভাগ্যে জোটেনি, যখন সেসবের ছিল সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ওরা এখন একসাথে। ওদের জন্য বুক ভরা ভালবাসা। সুখ সমৃদ্ধি ওদের ছায়া হয়ে থাকুক। “
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি উত্তম বড়ুয়ার স্ত্রী রিতা বড়ুয়া ও ছেলে আদিত্য বড়ুয়া গোপনে ফ্রান্সে রওনা হন। ফ্রান্সের সময় রোববার রাতে ( সোমবার সকালে ) তারা সেখানকার একটি বিমানবন্দরে পৌঁছান। উত্তম বড়ুয়া সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানান। পরে ছবি তুলে ফেইসবুক আইডিতে পোস্ট করে নিজের অস্থিত্ব জানান দেন। এরপরই খবরটি ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্রই আলোড়ন উঠে।
আর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হতে উত্তম বড়ুয়ার মা মাধু রাণী বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন বলে তথ্য দেন।
মাধু রাণী বড়ুয়া বলেন, বিগত ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ঘটনার পর থেকে উত্তমের কোন সন্ধান নেই। সেই থেকে উত্তমের সঙ্গে পরিবারের কোন ধরণের যোগাযোগ নেই।
ছেলের স্ত্রী রিতা বড়ুয়া ও নাতি আদিত্য বড়ুয়াসহ উত্তম ফ্রান্সে অবস্থান করা সম্পর্কেও কিছুই অবহিত নন বলে জানান তিনি।
এব্যাপারে রামু থানার ওসি মুহাম্মদ আরিফ হোছাইন বলেন, উত্তম বড়ুয়াকে স্ত্রী ও সন্তানসহ ফ্রান্সের একটি বিমানবন্দরে দেখতে পাওয়ার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রচারের বিষয়টি পুলিশের নজরে এসেছে। এব্যাপারে পুলিশের কাছে নিশ্চিত কোন তথ্য নেই। তারপরও পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
উল্লেখ্য, ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামু কেন্দ্রিয় সীমা বিহার পুরোপুরি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ধংস ও লুট করা হয় আড়াইশরও বেশী দুর্লভ বুদ্ধমূর্তি। একইভাবে রামু ও উখিয়ার আরও ১৮ টি বিহারে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়, হামলা করা হয় বৌদ্ধপল্লীতেও।
পরে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে- পরিকল্পিতভাবে উত্তমের ফেইসবুক পেইজে ‘ভুঁয়া ছবি’ ট্যাগ করে রামুর ফকিরাবাজারে বসে সেই ছবি দেখিয়ে উস্কে দেওয়া হয় স্থানীয় মুসলমানদের।
কিন্তু তখন উত্তমের হদিস পাওয়া যায়নি। তারপর ঘটনার তের বছর কেটে গেলেও কোন ধরণের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। এমন কি পুলিশ ও প্রশাসনের কাছেও তার সন্ধানের ব্যাপারে কোন ধরণের তথ্য ছিল না।



