Logo
Logo
×

সারাদেশ

তাবিজ তৈরির গ্রাম

বিলুপ্তির পথে ২০০ বছরের পুরনো তাবিজ শিল্প

Icon

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৪০ পিএম

বিলুপ্তির পথে ২০০ বছরের পুরনো তাবিজ শিল্প

ছবি : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাবিজ তৈরির গ্রাম মুসুরি এলাকা

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে উপজেলার মুসুরি এলাকাই তাবিজ তৈরির গ্রাম। তাবিজ তৈরি ছিল এক সময়ের একটি প্রাচীন ও জনপ্রিয় হস্তশিল্প। ২০০ বছরের পুরনো তাবিজের ব্যবসা এখন আর আগের মতো নেই।ধর্মীয় বিশ্বাস, লোকজ ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিক আস্থার প্রতীক হিসেবে তাবিজ বহুকাল ধরে মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে।তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। 

এই তাবিজ নিয়ে এখন আর কোন গীতিকার গান রচনা করেনা ওমোর বানিয়া বন্ধুরে একখান তাবিজ বানাইয়া দে। একখান মাদুলি বানাইয়া দে। মরিয়া গিয়াছে পিয়ারও সোয়ামি স্বপনে আইসে।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে তাবিজের কদর ছিল। তখন হাটবাজারের প্রায় প্রতিটি কোণায় একজন করে তাবিজ প্রস্তুতকারক পাওয়া যেত। তৎকালীন সময়ে ‘কবিরাজ’ পরিচয়ে খ্যাত পুরুষ হাকিম, পীর-মুর্শিদগণ তাবিজ লিখে তা বিতরণ করতেন। এই তাবিজে থাকতো কোরআনের আয়াত, আরবি দোয়া, অথবা বিশেষ সংখ্যার গণিত-চিহ্ন। রোগবালাই থেকে মুক্তি, সংসারিক কল্যাণ বা আত্মরক্ষা—সবই জড়িয়ে ছিল এই তাবিজে।

তাবিজ তখন শুধু একটি ধর্মীয় অনুষঙ্গ ছিল না, বরং একটি মানসিক নির্ভরতার মাধ্যম ছিল। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করত, তাবিজে মনের শান্তি ও সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

 খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে লোকজ ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিক আস্থার প্রতীক হিসেবে যে তাবিজ মানুষ ব্যবহার করত। সে তাবিজ প্রস্তুত করে তার চাহিদার সিংহ ভাগ জোগান দিত এই উপজেলার তাবিজ শিল্পীরা। সে সময় রূপগঞ্জের প্রায় অর্ধ সহস্রাধিক তাবিজ তৈরির কারিগর ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা,ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানা বিধ কারণে তাবিজের ব্যবহার কমেছে আশঙ্কা জনক হারে। 

অন্যদিকে পুঁজি সংকট ও কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি সবমিলিয়ে এ শিল্পে সংকট নেমে আসে। এরই ফলশ্রুতিতে অনেক তাবিজ তৈরীর কারিগররা এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। তবে এ চরম পরিস্থিতিতেও রূপগঞ্জের চোরাব, টান মুশরী, ভিংরাব, দক্ষিণবাগসহ সদর ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় এখনো দুই শতাধিক পরিবার তাবিজ তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। কেউ এটিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, কেউবা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রেখেছেন। শত বছরের পুরনো এ পেশাকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছেন তাঁরা।  

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিটি পরিবারের পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও তাবিজ তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এমনকি শিশু-কিশোররাও কাজে সহায়তা করছে। সাধারণত পরিবারের সব সদস্য সম্পৃক্ত হন তাবিজের কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়ায়। বছরজুড়ে রূপগঞ্জের ঘরে ঘরে দেখা মেলে তাবিজ আর মাদুলি বানানোর কর্মব্যস্ততা।

তাবিজ তৈরির কাজ অনেক পরিশ্রমসাধ্য। ধাতব তাবিজ বানাতে প্রথমে তামা, ব্রোঞ্জ, দস্তা, লোহা, পিতল ইত্যাদি কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হয়। এসব কাঁচামাল কিনতে হয় কেজি প্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। এরপর সাইজ অনুযায়ী কেটে তা সাচে ফেলে ঢালাই করা হয়। আগুনে ঝালাই, পাইন দিয়ে সিলিং এবং অবশেষে বিভিন্ন রঙের মেডিসিন দিয়ে তা রঙিন করা হয়। সম্পূর্ণ প্রস্তুতির পর তা বাজারে পাঠানো হয়। একটি পরিবার মাসে প্রায় ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার তাবিজ তৈরি করে থাকে।

তাবিজের রয়েছে বহু আঞ্চলিক নাম—সাম্বু, বাম্বু, পাই, বড় মাজলা, ছোট মাজলা, মস্তুল ইত্যাদি। এগুলো বিক্রি হয় শত বা হাজার হিসেবে। লোহার তাবিজের দাম কম হলেও পিতল, রূপা বা স্বর্ণের তাবিজের দাম তুলনামূলক বেশি।বর্তমানে এই শিল্পে চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে।

কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে তাবিজের ব্যবহার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা, শিক্ষার প্রসার এবং ধর্মীয় ব্যাখ্যার কারণে অনেকে তাবিজকে ‘শিরক’ বলে মনে করছেন, যা এর জনপ্রিয়তাকে আরও হ্রাস করেছে।

এক সময় রূপগঞ্জের তাবিজ শিল্প দেশের গণ্ডি পেরিয়ে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, এমনকি ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যেও রপ্তানি হতো। কিন্তু এখন সেই রপ্তানি প্রায় বন্ধ। আগের তুলনায় আয় কম, পরিশ্রম বেশি, আর পুঁজির অভাবে নতুন প্রজন্ম এই পেশায় আসতে অনাগ্রহী। 

এ শিল্পের প্রবীণ ও নবীন কারিগরদের কণ্ঠে রয়েছে হতাশা, তবুও পৈত্রিক পেশাকে টিকিয়ে রাখার প্রত্যয়। এ শিল্পের ব্যপক সাফল্য থাকলেও বর্তমানে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও পুঁজি সংকটে এ শিল্পের কারিগরদের দুঃখ-দুর্দশার যেনো শেষ নেই। শিল্পটি এখন অস্থিত্ব সংকটে। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সহজ শর্তে ঋণসহ কিছু সরকারি উদ্যোগ ও সুবিধা দিলে টিকিয়ে রাখা যেতে পারে এ ঐতিহ্যবাহী তাঁবিজ শিল্পকে। 

তাবিজের কারিগর রামপ্রসাদ অধিকারী বলেন, প্রতিটি তাবিজ তৈরি করতে প্রকারভেদে প্রতি পিচ খরচ পড়ে ৮০ পয়সা থেকে ১ টাকা। অথচ পাইকারদের পুঁজিতে ব্যবসা করায় তাদের কাছে ওই তাবিজটি বিক্রি করতে হচ্ছে ১টাকা ২০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৭০ পয়সায়। আর নিজস্ব পুঁজিতে ব্যবসা করলে একই তাবিজ বিক্রি করা যেতো দেড় টাকা থেকে ২ টাকা পর্যন্ত। 

৮০ বছর বয়সী তাবিজ কারিগর প্রিয় বালা রানী বলেন, আমার শশুর-শাশুড়ি এ তাবিজ বানাইত, এহন আমিও ওনাগো কাজটা ধইরা রাখছি।

তাবিজ প্রস্তুতকারক দিলীপ মন্ডল বলেন,

 রূপগঞ্জের মানুষ প্রায় ২০০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। আগে চাহিদা ছিল, আয়ও ভালো হতো। এখন আয় কম, খরচ বেশি। সরকারি সহায়তা পেলে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে

হয়তো এ পেশা ধরে রাখা সম্ভব হতো।

তাবিজ কারিগর নুরুল হক বলেন, ‘আমাদের তৈরি তাবিজ জেলা ছেড়ে চট্টগ্রামসহ ঢাকা, খুলনা, বগুড়া, বরিশাল, বরগুনা, গাজীপুর, নরসিংদী,কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ভোলাসহ দেশ ছাড়িয়ে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যেও রপ্তানি হয়। কখনো কখনো আমরাও দেশের বিভিন্ন জেলার হাট গুলোতে গিয়ে তাবিজ বিক্রি করি।

তাবিজ শিল্পী সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রতি মাসে একেকটি পরিবার প্রায় ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার তাবিজ তৈরি করেন।পাইকারদের পুঁজিতে ব্যবসা করায় ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে খুব একটা পারিশ্রমিক পাওয়া যায় না।এ আয় দিয়ে সংসার না চললেও বাপ দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।

 এ বিষয়ে হাফেজ, মাওলানা, মুফতি শিহাব উদ্দিন জানান,শরীয়তসম্মত দোয়াভিত্তিক তাবিজ বৈধ হলেও কুফরি জাদুবিদ্যার ভিত্তিতে তৈরি তাবিজ হারাম ও শিরকের শামিল। 

পরিশেষে ভারাক্রান্ত মনে বলতেহয় রূপগঞ্জের তাবিজ শিল্পের বর্তমান দুরবস্থার পেছনে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে।

এখন সময় এসেছে এই শিল্পটিকে সংরক্ষণের বিষয়ে নতুন করে ভাববার। এটি শুধুই একটি ধর্মীয় চর্চা নয়, বরং একটি ঐতিহ্যবাহী লোকজ শিল্প, যা হারিয়ে গেলে রূপগঞ্জ হারাবে তার অতীতের এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। এই শিল্প বাঁচাতে হলে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা, সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। তবেই হয়তো শত বছরের পুরনো এই ঐতিহ্য আবারও নতুন জীবন পাবে।

Swapno

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher

Major(Rtd)Humayan Kabir Ripon

Managing Editor

Email: [email protected]

অনুসরণ করুন