খিলগাঁও ফ্লাইওভারের ওপর দীর্ঘ সারিতে আটকে থাকা গাড়ির ফাঁক গলে দৌড়াচ্ছিলেন এক তরুণ। সঙ্গে লাগেজ, মুখে উৎকণ্ঠা—বিদেশগামী যাত্রী তিনি। পাশে থাকা সঙ্গী জানালেন, ফ্লাইট ধরার তাড়ায় আছেন তাঁরা। কারণ, ফ্লাইওভারের নিচে পানি জমে থাকা একটি গর্তে পিকআপ আটকে গিয়ে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ যানজট। রাজধানীতে এমন পরিস্থিতি এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়—যেখানে খানাখন্দ, অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি, যত্রতত্র পার্কিং ও হকারদের দখলে দুর্ভোগে নাকাল নাগরিকরা।
ঢাকা শহরের যাত্রাবাড়ী থেকে উত্তরা, ডেমরা থেকে খিলক্ষেত—সবখানেই একই চিত্র। সড়কের গর্ত, ভাঙা ড্রেন ও খুঁড়ে ফেলা রাস্তায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে লাখো মানুষকে। এতে যেমন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে বিপুল।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন ডেমরা, মাতুয়াইল, সায়েদাবাদ, মানিকনগর, মুগদা, মালিবাগ, রামপুরা, বাসাবো, মান্ডাসহ আশপাশের এলাকার সড়কগুলোয় দেখা গেছে দুর্দশার চিত্র। মাতুয়াইল মুসলিম নগর বাদশা মিয়া সড়ক, ডেমরা বালুরঘাট থেকে বাজার হয়ে জুট মিলে যাওয়ার সড়ক, পাইটি ওয়াসা রোড—সবখানেই খানাখন্দে ভরা। ডেমরার ডগাইর শাপলা চত্বর থেকে পশ্চিম সানারপাড় পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার রাস্তায় সংস্কারকাজ চলছে ঢিমেতালে।
স্থানীয় লতিফ বাওয়ানী জুট মিলের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাস্তাটা এত খারাপ যে সামান্য বৃষ্টিতেই চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে।
মানিকনগর-মুগদা ওয়াসা রোড, বাসাবো, নন্দীপাড়া ও গোড়ান এলাকার সড়কগুলোর অবস্থাও একই রকম। ড্রেনেজ ও সড়ক মেরামতের কাজ বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। অভিযোগ উঠেছে, সিটি করপোরেশন ও ঠিকাদারদের অবহেলায় দক্ষিণের ৬, ৭১ ও ৭২ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষাধিক মানুষ চরম দুর্ভোগে রয়েছেন।
উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতায় গুলশান, বনানী, বারিধারার বাইরে অনেক সড়কেরই বেহাল অবস্থা। উত্তরা থেকে আবদুল্লাহপুর হয়ে ধউর বেড়িবাঁধ পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও খানাখন্দের ছড়াছড়ি। দক্ষিণখানের কসাইবাড়ী থেকে উত্তরখানের কাঁচকুড়া বাজার পর্যন্ত সড়ক খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।
স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাজধানীতে বাস করি—এই রাস্তা দেখে কাউকে বললে বিশ্বাসই করবে না।
এ ছাড়া দক্ষিণখানের গণকবর সড়ক, আশকোনা-কাওলা সংযোগ সড়ক, খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ-২ এর সরকারবাড়ী থেকে নাগরিক টিভি-সংলগ্ন রাস্তাও ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে বা সংস্কারকাজ চলছে মন্থর গতিতে।
ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ বলেন, ইউটিলিটি লাইন ও অবৈধ দখলের কারণে কাজের গতি কম। ঠিকাদারের গাফিলতি পেলে চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানান, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পানি জমে থাকা সড়কগুলোর কাজ চলছে। গুলশান লেক এলাকায় হাঁটা যেত না, আমরা কাজটা করেছি। তেজগাঁও, উত্তরখান, দক্ষিণখানেও কাজ এগোচ্ছে, বলেন তিনি।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জোন-৮ নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহেব হোসেন বলেন, টেন্ডার হয়ে যাওয়া রাস্তার কাজ চলছে, বাকিগুলোর জন্য চেষ্টা করছি।
ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, বাজেট স্বল্পতা ও নির্বাচিত সরকার না থাকার কারণে কাজের গতি কিছুটা কমেছে, তবে সংস্কারকাজ বন্ধ নেই।
ঢাকা জেলা সড়ক ও জনপথ দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ডেমরার রাস্তাটি কিছুটা খারাপ। ইটের সোলিং করা আছে, দ্রুত মেরামত শুরু করব।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকার সড়কসংকটের মূল কারণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির অনুপস্থিতি এবং আন্তদপ্তর সমন্বয়ের অভাব। এসব না মেটালে ভোগান্তি আরও বাড়বে।



