বনানী কমিউনিটি সেন্টার কাঁচাবাজারে অবৈধ ৩৩ দোকান পুনর্বহাল
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৫৯ পিএম
ছবি-প্রতীকী
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) বনানী কমিউনিটি সেন্টার কাম-কাঁচাবাজারে ৩৩টি দোকান পুনর্বহালের ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও গোপন প্রক্রিয়ায় অনুমোদনের কেলেঙ্কারি। নয় বছর আগে নিরাপত্তাজনিত কারণে বাতিল হওয়া দোকানগুলো আইন বহির্ভূতভাবে পুনরায় স্থাপনের অনুমতি দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও আইনি দায় নিয়ে।
২০১৬ সালের ৩১ মার্চ বনানী কমিউনিটি সেন্টার কাম-কাঁচাবাজারে আগুন লাগার ঘটনার পর মার্কেটের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে ডিএনসিসি ওই বাজারের পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে অবস্থিত ৩৩টি অস্থায়ী দোকানের বরাদ্দ বাতিল করে। কিন্তু দীর্ঘ নয় বছর পর, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোনো প্রকাশ্য বরাদ্দ কমিটি সভা ছাড়াই গোপনে দোকানগুলো পুনর্বহালের অনুমোদন দেওয়া হয়।
ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগের নথি অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শওকত ওসমান স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়-“বকেয়া ভাড়া পরিশোধ সাপেক্ষে পূর্বের ন্যায় অস্থায়ী দোকান পুনঃস্থাপনের বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।” তবে অনুমোদনের এই নথিতে সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ার ও সম্পত্তি কর্মকর্তার স্বাক্ষর ছিল না এবং তা “অতি গোপনীয়ভাবে অনুমোদন” করা হয় বলে উল্লেখ রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মার্কেট উপ-আইন ২০১৩-এর ধারা ২৬ (১) অনুযায়ী, “কোনো দোকানের বরাদ্দ বাতিল হলে, বরাদ্দপ্রাপক ৩০ দিনের মধ্যে দোকানের ১২ মাসের ভাড়ার সমপরিমাণ টাকা পে-অর্ডার আকারে জমা দিয়ে পুনর্বহালের আবেদন করতে পারবেন।” এবং ধারা ২৬(২) বলছে— “আবেদন পাওয়ার পর বরাদ্দ কমিটি উপযুক্ত মনে করলে বাতিলকৃত বরাদ্দ পুনর্বহাল করতে পারবে।”
কিন্তু বনানী বাজারের ক্ষেত্রে— বরাদ্দ বাতিলের প্রায় ৯ বছর পরে আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্তরা একত্রে একটি আবেদন দিয়েছেন, যা আইনবিরুদ্ধ। ১২ মাসের ভাড়ার পে-অর্ডার জমা না দিয়েই আবেদন গৃহীত হয়েছে। বরাদ্দ কমিটির অনুমোদন ছাড়াই নথি অনুমোদিত হয়েছে।
এছাড়া, ২০১৬ সালে বাতিলকৃত দোকানগুলো ২০২২ সালের ২১ জুলাই উচ্ছেদও করা হয়। কিন্তু উচ্ছেদের পরও ওই দোকানগুলোর বকেয়া ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যা আইনি দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রকৌশল বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ৩৩টি দোকান মূল মার্কেট নকশার বাইরে এবং গ্রিন জোনের জায়গায় অবৈধভাবে নির্মিত।
নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “গ্রিন জোনে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ শুধু উপ-আইন ভঙ্গ নয়, বরং নগর সুরক্ষা ও জননিরাপত্তার জন্য হুমকি।”
ডিএনসিসির নথি অনুযায়ী, ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৩৩টি দোকানের বকেয়া ভাড়া ২৯ লাখ ৫০ হাজার ৩২০ টাকা, যার সঙ্গে ১৫% ভ্যাট ও ১০% আয়কর মিলিয়ে আরও ৭ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮০ টাকা সরকারি তহবিলে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তবে নগর প্রশাসন বিষয়ক এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, “বাতিল দোকানের জন্য ভাড়া আদায় আইনসঙ্গত নয়। বরাদ্দ বাতিলের পর দোকানের দখল বেআইনি হয়ে যায়, তখন কোনো আর্থিক দায় তৈরি হয় না।”
ডিএনসিসির এক ঘনিষ্ট সূত্র বলছে, “এখানে স্পষ্টভাবে উপ-আইন ভঙ্গ হয়েছে। বরাদ্দ কমিটির কোনো বৈঠক ছাড়াই দোকান পুনর্বহাল করা হয়েছে। এটি প্রশাসনিক অপরাধ এবং দুর্নীতির শামিল।”
অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, “আমরা ন্যায্যভাবে দোকান পেতে চাই, কিন্তু যেভাবে গোপনে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা সবার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর ঢাকা প্রতিনিধি আবদুস সালাম খান বলেন, “এই অনুমোদনের ঘটনায় প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিষয়টি দুদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যৌথ তদন্তের আওতায় আনা উচিত।”
বনানী কমিউনিটি সেন্টার কাঁচাবাজারে ৩৩ দোকানের অবৈধ পুনর্বহাল শুধু একটি প্রশাসনিক ভুল নয়, এটি আইনের প্রতি অবহেলা ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির সংকটের প্রতিফলন। উপ-আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন সত্ত্বেও গোপনে অনুমোদন প্রদানের ঘটনা ডিএনসিসির প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় নতুন প্রশ্ন তুলেছে।
নগরবাসীর দাবি—এ ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।



