
প্রিন্ট: ৩০ মার্চ ২০২৫, ০১:৫১ এএম
বিমানবাহিনীর তৎপরতায় বিমানবন্দরে শৃঙ্খলা, হতাশ চোরাচালান সিন্ডিকেট

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৫, ০৯:৪২ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে একসময় চোরাচালান, মানব পাচার ও লাগেজ চুরির মতো অপরাধ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এসব অপরাধের পাশাপাশি ঘুষ ও চাঁদাবাজির চক্রও বিমানবন্দরের প্রতিটি স্তরে বিস্তৃত ছিল। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব অপরাধে জড়িত থাকার বিষয়টি নানা সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। যাত্রীদের দুর্ভোগ নিয়ে সংবাদমাধ্যমেও একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কিছুসংখ্যক সদস্যকে মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর পর থেকেই বিমানবন্দরের চিত্র বদলাতে শুরু করে। বিমানবাহিনীর উপস্থিতির ফলে সিভিল এভিয়েশনের অসৎ কর্মচারীদের অবৈধ উপার্জনের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তবে কিছু অসাধু কর্মকর্তা চোরাচালান, মানব পাচার ও মাদক ব্যবসা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সিভিল এভিয়েশনের বেশ কয়েকজন সদস্য এসব অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেপ্তার হন।
বিমানবাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে চোরাচালান সিন্ডিকেট ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে তারা বিমানবাহিনীর সদস্যদের সরানোর জন্য নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৭ মার্চ সকাল ১০টা থেকে বেবিচকের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়, যা রাজধানী ও দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চলের সংযোগ ব্যাহত করে। বিদেশগামী অনেক যাত্রী ফ্লাইট মিস করেন, ফলে সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে।
এ প্রসঙ্গে বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিমানবাহিনীর উপস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে চলমান ঘুষ ও অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ২০০-৫০০ টাকার বিনিময়ে অননুমোদিত ব্যক্তিদের টার্মিনালে প্রবেশ করানো, ৫০০-১০০০ টাকায় প্রোটোকল অফিসারদের ব্রিজ এলাকায় পাঠানো এবং লাগেজ চুরির মতো কার্যক্রম ছিল নিয়মিত চর্চা। কিন্তু বিমানবাহিনীর কড়া নজরদারির ফলে এসব কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়েছে, তাই চোরাচালান সিন্ডিকেট বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে, কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আন্দোলনকে ইন্ধন দিয়েছে। বেবিচকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত। আন্দোলনকে বেগবান করতে সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর ভাই সাদ্দাম (ছাত্রলীগ সম্পাদক, নোয়াখালী), তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ASG ইদ্রিস আলী মানিকসহ প্রায় ১২০ জন বহিরাগত সন্ত্রাসী ভাড়া করে আনা হয়।
বেবিচকের এক কর্মচারী জানান, “কিছু অসাধু কর্মচারীর জন্য আমরা নিজেরাও ঠিকমতো কাজ করতে পারি না। আন্দোলনে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে আনা হয়েছে। বিমানবাহিনী তো ভালো কাজ করছে, তাদের সরালে বিমানবন্দরের পুরোনো দুর্নীতির চিত্র ফিরে আসবে।”
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন দায়িত্ব ছেড়ে দিলে বিমানবাহিনী বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এরপর থেকে স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক ব্যবসা ও লাগেজ চুরির মতো অপরাধ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আসে। ফলে বিমানবন্দরের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে।
বিশ্বমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। লন্ডন, ম্যানচেস্টার, টরন্টোসহ ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে নির্বিঘ্নে ফ্লাইট চলাচল করছে এবং নিউ ইয়র্কেও সরাসরি ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনা চলছে।
বিমানবাহিনীর শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থাপনার ফলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (HSIA) গত বছরে এককভাবে ৩০০০ কোটির বেশি রাজস্ব অর্জন করেছে এবং ১২.৫ মিলিয়ন যাত্রীর যাতায়াত নিশ্চিত হয়েছে—যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন বিভাগের সমন্বিত কার্যক্রমের ফলে যাত্রীসেবার মানও বহুগুণে বেড়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও যাত্রীদের অভিমত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তারা বিমানবন্দরে বিমানবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট। অনেকেই নিরাপত্তা ও সেবার মান ধরে রাখতে বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্স গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
বিমানবন্দরে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখা শুধু সরকারের সাফল্যের প্রতীক নয়, এটি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী যাতে পুনরায় বিমানবন্দরে অপরাধমূলক কার্যক্রম চালু করতে না পারে, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।