ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে সুন্দরবনে অসংখ্য প্রাণহানি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ০১:০১ পিএম
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পুরো সুন্দরবন ডুবে ছিল প্রায় ৩০ ঘণ্টা। এত দীর্ঘ সময় উঁচু জোয়ার থাকায় বন্যপ্রাণীর বিপুল ক্ষতির শঙ্কা করছিলেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল মঙ্গলবার সকালে পানি নামার পর সেই আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। বনের কটকা, কচিখালী, দুবলা ও হিরণ পয়েন্টের সৈকতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে মৃত হরিণ। গতকালই এমন ৪০টি হরিণ উদ্ধার করে মাটিচাপা দিয়েছে বন বিভাগ। তবে বিশাল আয়তনের সুন্দরবনে প্রাণিকুলের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা জানাতে পারেনি বন বিভাগ। এ ছাড়া তীব্র বাতাসে উপড়ে গেছে প্রচুর গাছপালা, ভেঙেছে অসংখ্য গাছের ডালপালা। সাগরের নোনাপানি ঢুকে গেছে বন্যপ্রাণীর জন্য তৈরি করা মিঠাপানির পুকুরসহ শতাধিক জলাশয়ে।
সরেজমিন গতকাল সকালে সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্রে দেখা যায়, সৈকতের বিভিন্ন স্থানে মৃত হরিণ পড়ে আছে। ঝড়ে উড়ে আসা গাছের ডালপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বাতাসের আঘাতে ভেঙে গেছে বন বিভাগের ছোট স্থাপনা। বিবর্ণ রূপ নিয়েছে চিরচেনা সুন্দরবন।
সুন্দরবন পশ্চিম ও পূর্ব বন বিভাগ বলছে, প্রাথমিক হিসাবে মঙ্গলবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত তারা ৪০টি হরিণ ও একটি বন্য শূকরের মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ১৭টি হরিণ। বনের শতাধিক মিঠাপানির পুকুর প্লাবিত হয়ে সাগরের পানি ঢুকে পড়েছে। বন বিভাগের বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে প্রাণী বা বনের ক্ষতির সঠিক হিসাব বের করা আসলেই কঠিন। কারণ, প্রায় সাড়ে ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বনের অনেক অংশে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। সাগর ও নদী উত্তাল থাকায় অনেক এলাকায় যেতেও পারছেন না বন বিভাগের কর্মীরা। এসব তথ্য দিতে আরও সময় প্রয়োজন।
এদিকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতে গতকাল সন্ধ্যায় একটি মৃত চিত্রা হরিণ ভেসে আসে। পরে অ্যানিম্যাল লাভার্সের সদস্যদের খবর দিলে তারা এসে বন বিভাগের সহায়তায় হরিণটির মৃতদেহ মাটিচাপা দেয়।
ঘূর্ণিঝড় রেমালে এবার সুন্দরবন ‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে জানিয়ে বন বিভাগ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে ২৪ ঘণ্টায় দু’বার ভাটা এবং দু’বার জোয়ারে প্লাবিত হয় সুন্দরবনের একটি অংশ। কিন্তু এবারই প্রথম ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগ থেকে পরবর্তী প্রায় ৩০ ঘণ্টা পুরো বন তলিয়ে ছিল। জোয়ারের পানির উচ্চতাও ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট বেশি। দীর্ঘ সময় পানি আটকে থাকায় এবং বাতাসে গাছ পড়েছে অনেক বেশি।
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী ও প্রজনন কেন্দ্রে কর্মরত হাওলাদার আজাদ কবির। আজাদ কবির বলেন, স্বাভাবিক জোয়ারের সময় সুন্দরবনে যে পানি হয়, এবার তার চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট পানি বেশি হয়েছে। আর জোয়ারের পানি স্থায়িত্ব ছিল অনেক সময় ধরে। এত পানির চাপ অতীতে কখনও দেখিনি।
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনের প্রাণীরা জোয়ার-ভাটায় অভ্যস্ত। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় ধরে উঁচু জোয়ার বন্যপ্রাণীরা কতটা সামলাতে পারবে, তা নিয়ে নানা আশঙ্কা ছিল। সকালে করমজলে মৃত দুটি হরিণ ও একটি বন্য শূকর পেয়ে মাটিচাপা দিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় আরও মৃত হরিণ পাওয়া গেছে বলে শুনেছি।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের (খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, জলোচ্ছ্বাসে ১৪টি পুকুরের পাড় ভেঙে গেছে। ১৮টি জেটি, ১১ কিলোমিটার গোলপাতার বাগান, ২ হাজার ৬৩০ ফুট রাস্তা ও বাঁধ, ৯টি সড়ক ও বনরক্ষীদের তিনটি ব্যারাক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সোলার প্যানেল উড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুটি ওয়্যারলেস টাওয়ার। একটি পন্টুন ভেসে গেছে। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ২ কোটি ৬১ লাখ। তবে ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা টাকার অঙ্কে নিরূপণ সম্ভব নয়। বনের গাছে হাজার হাজার পাখি ছিল; ডিম-বাচ্চা ছিল। এখন গাছে কোনো পাখি নেই। যত হরিণ মারা গেছে, গাছ নষ্ট হয়েছে, টাকা দিয়ে এসব মাপা যায় না। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগবে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের (বাগেরহাট) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, বাগেরহাট শহর থেকে বনের অভ্যন্তরে ১০০ কিলোমিটার দূরে সাগরের কাছাকাছি আমাদের স্টেশন রয়েছে। তবে সাগর ও নদী উত্তাল থাকায় আমরা সব জায়গায় যেতে পারছি না। বনে প্রায় ৩০ ঘণ্টা জলোচ্ছ্বাস ছিল, যার ফলে অনেক বন্যপ্রাণী মারা যাওয়ার কথা শুনতে পাচ্ছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ না করে সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া সম্ভব হবে না।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, এবার যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি সুন্দরবন হয়েছে, তা আগে কখনও হয়নি। এ কারণে ক্ষতি হয়েছে বেশি, যার সঠিক তথ্য বের করতে সময় প্রয়োজন।