বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ অব্যাহত রাখার দাবি
মোরছালীন বাবলা
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
সুন্দরবন। ছবি : সংগৃহীত
নানা ধরনের দূষণই বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের অন্যতম কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের জন্য পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। তাই সঠিক বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব বলেও তারা মত দেন।
তারা বলছেন, পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলায় ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যাপক হারে বনায়ন, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি, ভূমির ক্ষয়রোধের মাধ্যমে ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের গতি বাড়ানো সম্ভব। জাতিসংঘ ২০২১ থেকে ২০৩০ দশককে ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই সময়ে বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘ ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা পরিচালনা করেছে।
বাংলাদেশেও জাতিসংঘ ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারে প্রকল্প পরিচালনা করছে। সরকার, দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থা ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারে জোরালো ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যে অক্সফাম ইন বাংলাদেশ অন্যতম। ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অক্সফাম বাংলাদেশ ‘ব্লু ইকোনমি অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের লক্ষ্য হলো- টেকসই জলবায়ু আন্দোলন, ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর বাস্তুতন্ত্র ও সুষম অর্থনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন করা।
বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার, আন্তর্জাতিক বা কিছু দেশীয় সংস্থা যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ৫১টি অভয়ারণ্য ঘোষণা, নদী পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা, বঙ্গোপসাগরে সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের প্রথম সামুদ্রিক অভয়ারণ্য সৃষ্টি। এ ছাড়া আইইউসিএন বা জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশি জীববৈচিত্র্যের ডেটাবেস তৈরি এবং বিভিন্ন উদ্ভাবনী
প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের অনেক স্থানের বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করছে।
ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) অধীনে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের কয়েকটি জেলার আটটি উপজেলায় ‘খরাপ্রবণ বরেন্দ্রভূমি এবং হাওর জলাভূমি এলাকায় ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক প্রকল্প পরিচালনা করা হয়। ৫৫ মিলিয়ন (৫ কোটি ৫০ লাখ) মার্কিন ডলারের এ প্রকল্প পরিচালিত হয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সুবিধাভোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ হাজার।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাসিন্দা আজিজার রহমান জানান, প্রকল্প থেকে এলাকার কৃষকরা অনেক সহায়তা পেয়েছেন। ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের কৌশল হিসেবে কৃষকরা ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর উপায় আয়ত্ত করেছিলেন। সেই কৌশল কাজে লাগিয়ে এখানককার কৃষকরা ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখছেন।
তিনি বলেন, আমরা পরিবেশের ক্ষতি না করে, কম কীটনাশক অথবা সার ব্যবহার না করে সবজি চাষ শিখেছি। ভালো ফল পাচ্ছি। আমরা পরেবেশকে বিরক্ত না করলে সবাই ভালো থাকব।
সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারে কাজ করে ভিএনভি অ্যাডভাইজরি। ‘বাংলাদেশে একটি টেকসই ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা’ শিরোনামে প্রকল্প পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। নোয়াখালী, ভোলা ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে ম্যানগ্রোভ গাছ রোপণ করেছে। প্রকল্পটি পরিবেশ এবং স্থানীয় জনগণের জন্য সুফল নিয়ে এসেছে। এটি নিচু কৃষিজমিতে ক্ষয় ও লবণের অনুপ্রবেশের ঝুঁকি কমিয়ে জীববৈচিত্র্য ও খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়েছে।
সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার কয়রা এলাকার মৌয়াল আবু বক্কর বলেন, মৌমাছি কমে যাওয়ায় বাপ-দাদার পেশা হারাতে হচ্ছিল। বিপদে পাশে দাঁড়ায় এনজিও। এখন সুন্দরবনে মৌমাছি রক্ষায় কাজ করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে আমরা আমাদের পেশায় এখনও টিকে আছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক সামশাদ নওরীন বলেন, দক্ষ জনবল এবং সঠিক নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে আমাদের আগামী এক দশকের ‘ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন’ বা বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মতো মহতী উদ্যোগের সঙ্গে আরও বেশি মাত্রায় ভূমিকা রেখে এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বাস্তবসম্মত প্রয়োগের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সঠিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ ছাড়া জনগণকে বাস্তুতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করানোর জন্য বিভিন্ন বয়সভেদে সচেতনতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।
তিনি বলেন, অন্য প্রজাতির জীবকে দেশে অভিযোজিত করার আগে অনেক গবেষণা করা উচিত এবং সর্বোপরি নিরুৎসাহিত করা উচিত। অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ, বন্য প্রাণী নিধন, জলাভূমি দখল বা নদীর নাব্য বৃদ্ধি রোধ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকলে বাস্তুতন্ত্র পুনঃস্থাপনের সম্ভাব্য ব্যয় কমে আসবে, অন্যথায় ভবিষ্যতে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের ফলে আমাদের পরোক্ষভাবে অনেক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
নদী ও পরিবেশবিষয়ক সংগঠক, গবেষক, লেখক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, আমার ও অন্যান্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যক্তিদের সহযোগিতায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৩০০টির বেশি প্রজাতির ৩৬ হাজার ফলদ, বনজ, ঔষধি ও দুর্লভ প্রজাতির গাছ রোপণ করা হয়েছে। দেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বৈচিত্র্যময় গাছ নেই। বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার যে স্থানে করতে হবে, সেই স্থান কী ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে সেটি প্রথমে জানতে হবে। সেই সঙ্গে ওই স্থানের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। যেহেতু বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার খুব সহজ পদ্ধতি নয়, সেহেতু যে স্থানের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের পথে, সেখানে কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হয়। প্রাথমিকভাবে পুনর্বাসন একটি ধাপ, যার মাধ্যমে একটি স্থানের যেসব সম্পদ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট না করে ব্যবহার উপযোগী করা যাবে, সেটি বের করতে হবে। এরপর বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের নিয়ামকগুলোকে প্রতিকারের আওতায় আনতে হবে। এরপর স্থানীয় প্রজাতির জীব পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং প্রতিস্থাপন করতে হবে। এটির মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে এটি কারও একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়াটির বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব।